মহামারীর কারণে কাজ হারানো পোশাক শ্রমিকদের প্রণোদনা হিসেবে ১১ কোটি ৭০ লাখ ইউরো দেওয়ার যে প্রস্তাব তিন মাস আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। কর্মহীন হওয়া শ্রমিকের তালিকা না থাকা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও সজ্ঞায়ন না হওয়া এবং মালিকপক্ষের মতানৈক্যের কারণে এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এখনও পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ। সরকারের আর্থিক সম্পর্ক বিভাগ এবং পোশাক কারখানার মালিক পক্ষ বলছে, এই প্রণোদনা কাদের দেওয়া হবে, কীভাবে দেওয়া হবে- তা নিয়ে আগামী সপ্তাহে ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক করার কথা ভাবছেন তারা। চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে সব দেশেই কর্মসংস্থান ও আর্থিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পেও কর্মীদের বেতন-ভাতা, উৎপাদন ও রপ্তানি প্রক্রিয়া নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। মালিকপক্ষের হিসাবে, গত মার্চ বাংলাদেশে ভাইরাসের প্রদুর্ভাবের শুরুর দিকেই প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছিল। অবশ্য এর মধ্যে কিছু কাজ পরে ফিরে আসে। এই সঙ্কটে কারখানা বন্ধ হওয়ায় এপ্রিল, মে ও জুন মাসে পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ‘কয়েক লাখ’ চাকরিচ্যুত হন বলে শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্য। ওই পরিস্থিতিতে ক্রয়াদেশ বাতিল না করতে এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে ক্রেতা কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। দফায় দফায় আলোচনার পর কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য প্রণোদনা দেওয়ার একটি প্রস্তাবও দিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রাজধানীর মৌচাকে স্নোটেক্স নামের একটি গার্মেন্টসে ঢোকার আগে শ্রমিকদের তামমাত্রা মাপা হচ্ছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভিঅর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ইউরোপ শাখার কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জুনের শুরুতে ওই প্রস্তাবে ১১৭ মিলিয়ন ইউরো (ইইউ ৯৭ মিলিয়ন ইউরো, জার্মানি ২০ মিলিয়ন ইউরো) দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল কাজ হারানো পোশাক শ্রমিকদের সহায়তার জন্য। “এখান থেকে কারা সহায়তা পাবেন, কত টাকা পাবেন- সেসব নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে, আরও আলোচনা হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারব বলে আমরা আশা করছি।” একাধিক কারখানা মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষয়টি তিন মাস ধরে আটকে আছে মূলত চাকরিচ্যুত কিংবা কাজ হারানো শ্রমিকের সজ্ঞায়ন এবং তাদের সংখ্যা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতার কারণে। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সহায়তা চেয়েছিলাম মার্চে তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায়। কার্যাদেশ বাতিল হওয়ার কারণে যে ধরনের সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল সরকার নিজ থেকে এগিয়ে এসে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে তা দূর করেছে। আর এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতে অনেক কারখানায় কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। “এসব কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট কারখানা যেগুলো রয়েছে, যারা সরকারি ঋণ সুবিধার জন্য নির্বাচিত হতে পারেনি এবং বেতন ভাতা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে, তাদের চিহ্নত করে এসব কারখানার শ্রমিকদের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেটা ভাবা হচ্ছে। যারা আর্থিক সঙ্কটের কারণে এক্সিট রুট চায়, তাদের শ্রমিকদের সহায়তাও এই অর্থ থেকে করা যেতে পারে।” রপ্তানিমুখী একটি গার্মেন্ট কারখানার মালিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইইউ চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের তালিকা চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এমন তালিকা তৈরি করা সরকার বা আমাদের পক্ষে কঠিন। ফলে চাকরিচ্যুত শ্রমিক নির্বাচন করে প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা কঠিন।” এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রুবানা হক বলেন, বেতনের পরিপূরক হিসাবে নয়; বরং এখন শ্রমিকদের খাদ্য ভাতা (ফুট সাবসিডি) ওষুধ ভাতা, চিকিৎসা ভাতা কিংবা তাদের জন্য ‘ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল করে দিলে ওই অর্থ হয়ত সব শ্রমিকের উপকারে লাগবে। “বেশি জটিলতা দেখা দিলে সেই প্রস্তাবও আমরা (ইউরোপীয় ইউনিয়নকে) দেব।” তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের শ্রমে পুষ্ট হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। পোশাক রপ্তানিকারকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শ্রমিকরা কেউ প্রণোদনার অর্থের জন্য এতদিন বসে নেই। কোনো না কোনো পেশায় তারা যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। “ইতোমধ্যে কারখানাগুলোতে কার্যাদেশ বেড়েছে। অনেকই সে অনুযায়ী নতুন করে লোক নিয়োগ দিচ্ছেন। ফলে কর্মহীনদের অনেকেই আবার কাজে যোগ দিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় বেকার কিংবা কর্মহীন শ্রমিক চিহ্নত করা কঠিন হয়ে যাবে।” “ফলে কর্মহীন পোশাক শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে প্রস্তাব, সেটা এখন কতটা বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্ন আসছে। সে কারণেই এর বাস্তবায়ন নিয়ে বিলম্ব হচ্ছে।” সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, “কর্তৃপক্ষ এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এটা নিয়ে আলোচনাও থেমে আছে। তবে আগামী সপ্তাহে নতুন করে আলোচনা শুরুর কথা রয়েছে।”