আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম কিছুটা বাড়তি। তাই দেশের বাজারে সুতার দাম বেড়েছে। এতে নতুন করে বিপদে পড়ছেন তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। কারণ, পোশাকের উৎপাদন খরচ বাড়লেও উদ্যোক্তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করতে পারছেন না।
উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনায় এমনিতেই রপ্তানিমুখী পোশাক খাত কঠিন সময় পার করছে। এই অবস্থায় সুতার দাম বাড়ায় কাপড়ের দাম বেড়ে গেছে। সে জন্য চলমান ও নতুন ক্রয়াদেশের মধ্যে যেসব কারখানার সুতা বা কাপড় কেনা হয়নি, সেগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা পোশাকের বাড়তি দাম দিচ্ছেন না। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে পোশাকশিল্পের মালিকদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাসখানেক আগে যেখানে প্রতি পাউন্ড তুলা গড়ে ৭৫ সেন্টে বিক্রি হয়েছে, সেখানে বর্তমানে তা বেড়ে ৯০ সেন্টের কাছাকাছি পৌঁছেছে। অন্যদিকে অর্গানিক তুলার দাম ১ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তাতে দেশে সাধারণ সুতার দাম কেজিতে ২৫-৩০ সেন্ট পর্যন্ত বেড়ে গেছে। আর অর্গানিক সুতার দাম বেড়েছে ৬০-৮০ সেন্ট পর্যন্ত।
বস্ত্রকলের মালিকদের কাছে সুতার মজুত নেই। আর্থিক সংকটে অনেকে তুলা কিনতে পারছেন না। অন্যদিকে চাহিদা বেশি। সে কারণে দামও খানিকটা বাড়তি।
মোহাম্মদ আলী খোকন, সভাপতি, বিটিএমএ
জানতে চাইলে বাদশা টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদশা মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবার তুলার উৎপাদন কম হয়েছে। তা ছাড়া চীনারা প্রচুর পরিমাণে তুলা ও সুতা কিনে মজুত করেছে। সে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম কিছুটা বাড়তি। আর সুতা আমদানিতে কনটেইনার পরিবহনের ব্যয়ও আগের চেয়ে বেশি। তিনি আরও বলেন, তুলার দাম যে হারে বেড়েছে, সেই তুলনায় সুতার দাম কম বেড়েছে। এখনো ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে সুতার দাম কম।
বস্ত্রকলের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে ৮২ লাখ বেল (৪৮০ পাউন্ডে এক বেল) তুলা আমদানি হয়। তা ২০১৯ সালে কমে ৭১ লাখ বেলে দাঁড়ায়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ বা ২৬ লাখ ২৭ হাজার বেল তুলা আফ্রিকা থেকে এসেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ বা ১৮ লাখ ৪৬ হাজার বেল তুলা ভারত থেকে আমদানি করেছেন বস্ত্রকলের মালিকেরা। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে বাকি ৩৭ শতাংশ তুলা এসেছে।
নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশন গত মাসে একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে প্রতি পিস টি–শার্টের জন্য ১ ডলার ৫৫ সেন্ট মূল্য প্রস্তাব করে। এক মাসের ব্যবধানে সুতার দাম বাড়ায় প্রতি পিসের খরচ বেড়েছে সাড়ে ছয় সেন্ট। গত সপ্তাহে সেই ক্রেতা প্রতি পিস টি–শার্টের দাম দিতে চেয়েছেন ১ ডলার ৩৫ সেন্ট। দামে না পোষানোর কারণে ক্রয়াদেশটি ফিরিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
হঠাৎ করে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। আগের নেওয়া কিছু ক্রয়াদেশে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ হাতেম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এমবি নিট ফ্যাশন
বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ করে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। আগের নেওয়া কিছু ক্রয়াদেশে লোকসান গুনতে হচ্ছে। ক্রেতাদের সুতার বাড়তি দামের কথা জানালে তাঁরা বলছেন, এই ব্যাপারে তাঁদের কিছু করার নেই।’
নারায়ণগঞ্জের আরেক প্রতিষ্ঠান প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, ‘সুতার বাজার খুবই অস্থিতিশীল। প্রায় প্রতিদিনই দাম বাড়ছে। বড়দিনের ছুটি শেষে চলতি মাসে যখন ক্রেতারা ক্রয়াদেশ চূড়ান্ত করবেন, তখনই মূল সমস্যাটাহবে। ছুটির আগে পোশাকের দামের বিষয়ে দর–কষাকষি শেষ হয়েছে। কিন্তু তারপরও সুতার দাম বেড়েছে। সেই বাড়তি দাম সমন্বয় না করলে বড় রকমের সমস্যায় পড়তে হবে আমাদের।’
ক্রেতাদের সঙ্গে যখন পোশাকের দাম নিয়ে দর–কষাকষি হয়, তখন বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী সুতার দাম প্রস্তাব করেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। তারপর ১৫ দিন থেকে এক মাস পর ক্রেতারা চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ দেন। এই সময়ের মধ্যে সুতার দাম বাড়লে বিপদে পড়েন উদ্যোক্তারা। তবে মাঝে সুতার দাম ব্যাপক কমে যাওয়ায় লাভবান হয়েছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময় ক্রয়াদেশে বাতিল ও স্থগিত হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সুতার দাম ফেলে দেওয়া হয়েছিল। প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে খরচ পৌনে তিন ডলার হলেও তখন বিক্রি করতে হয়েছে ২ ডলার ২০ সেন্টে। সেই সুতা বর্তমানে ৩ ডলার ১৫ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। তুলার দাম যে হারে বেড়েছে, সেই হারে সুতার দাম বাড়েনি। তিনি বলেন, বস্ত্রকলের মালিকদের কাছে সুতার মজুত নেই। আর্থিক সংকটে অনেকে তুলা কিনতে পারছেন না। অন্যদিকে চাহিদা বেশি। সে কারণে দামও খানিকটা বাড়তি।