করোনার সময়ে তৈরি পোশাকের সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে এ খাতের শ্রমিকের আয়ের ওপরও। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এ খাতের শ্রমিকদের গড়ে আয় কমেছে ৮ শতাংশ। এর ফলে ৫৮ শতাংশ শ্রমিকের আর্থিক চাপ আগের তুলনায় বেড়েছে। আয় কমে যাওয়ায় ৮২ শতাংশ শ্রমিকের দৈনিক খাবার গ্রহণও অতীতের তুলনায় কমে গেছে। শুধু তাই নয়, এই সময়ে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের হয়রানিও বেড়েছে ১৭ শতাংশ। শনিবার ‘রিকভারি অব দ্য অ্যাপারেল সেক্টর ফ্রম দ্য কোভিড-১৯ ক্রাইসিস : ইজ অ্যা ভ্যালু চেইন বেসড পসিবল?’ শীর্ষক সংলাপে আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিডি ঐ জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনিশ। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ওপর জরিপকাজটি চালানো হয়। যৌথভাবে জরিপকাজটি পরিচালনা করে সিপিডি ও পলিসি স্টাডিজ অব শ্রীলঙ্কা। জরিপের বিস্তারিত তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। জরিপে করোনার এই সময়ে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে তুলনামূলক চিত্র দেখানো হয়। এতে দেখা যায় বেশকিছু ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে করোনা শুরু হওয়ার পর তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের চাকরি হারানো নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, বর্তমান সময়ে এসে ঐ অনিশ্চয়তা অনেকটাই কমেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ৩৬ শতাংশ শ্রমিক তাদের চাকরি নিয়ে খুবই অনিশ্চয়তায় ছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই চরম অনিশ্চয়তা চার শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও শ্রীলঙ্কায় এই অনিশ্চয়তা কমেনি, বরং কিছুটা বেড়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনা মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা ঢালাও ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে। পরবর্তী সময়ে এর বেশির ভাগই ফিরে এলেও দর কমেছে। এছাড়া এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকার সহায়তা দিলেও শ্রমিক ছাঁটাই ও লে অফের মতো ঘটনা ঘটেছে। এমনকি এখনো নিরবে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। আবার অনেক কারখানা নতুন নিয়োগও দিচ্ছে। এ সময় বলা হয়, গত বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৪ দশমিক ৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও চলতি বছর ঘুরে দাঁড়াবে। এটি ইতিবাচকভাবে ঘুরে প্রায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। তবে তা সত্ত্বেও কর্মসংস্থান বাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলবে না। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী সম্মিলিতভাবে এ সংকট মোকাবিলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গার্মেন্টস খাতের ওপর চাপ এলে শ্রমিকদের বিপদ বাড়বে। তাদের অস্তিত্বও প্রশ্নের মুখে পড়বে। সরকার আবারও প্রণোদনা দেবে—এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, সময় বাড়াবে (ঋণের সুদ পরিশোধের)—সে চিন্তা হচ্ছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় আঞ্চলিক ঐক্যের ওপর বিশেষ জোর দেন। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, শ্রমিকদের রক্ষায় সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিমাব্যবস্থা চালু করা এবং রিজিওনাল রেসপন্স প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) শ্রমিক কার্যক্রম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ বলেন, সরকার এ খাতের জন্য প্রণোদনার আওতায় সহায়তা দিলেও নিচের দিকে এ সহায়তা পৌঁচাচ্ছে না। কোনো সমিতির (বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ) সদস্য নয়; কিন্তু রপ্তানির পোশাক তৈরি করে, তাদের বিষয়টি দেখা দরকার। এ খাতের জন্য টেকসই ব্যবস্থা তৈরি করতে কেন্দ্রীয় সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। এ ধরনের সংকট মোকাবিলা আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক। তবে এখনো নীরবে শ্রমিক ছাঁটাইসংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে তিনি আপত্তি তোলেন। প্রতিবেদনে কিছু বিষয়কে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যউপাত্ত দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে প্রণোদনার ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরো অন্তত ছয় মাস বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধও জানান তিনি। সংলাপে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম, বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারওয়েজ, ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়া অঞ্চলের প্রধান জিয়াউর রহমান, শ্রমিক নেতা আমিরুল হক আমিন, কল্পনা আক্তার, বাবুল আক্তার, তৌহিদুল ইসলাম প্রমুখ।