তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রম পরিবেশের উন্নতি দরকার। সব সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ক্রেতাদের চাপে নয়, পরিবর্তন আনতে হবে নিজেদের গরজে বা সদিচ্ছায়। তবে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে চাপের দরকার আছে। গতকাল এক ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে আলোচকেরা আক্ষেপ নিয়ে এসব কথা বলেন। শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি থাকলেও কারখানাগুলোতে তা এখনো অতটা সক্রিয় নয়। ছোটখাটো অনেক বিরোধ দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় কমিটিগুলো মেটাতে পারছে না। শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে। সেই বিক্ষোভ ঠেকাতে শেষমেশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডাকতে হচ্ছে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা লাগছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ নিয়ে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে বেরিয়ে যাবে। তবে এ উত্তরণ মসৃণ ও ধারাবাহিক রাখতে শ্রম আইন ও অধিকারবিষয়ক অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। মসৃণ উত্তরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শ্রমমান পরিস্থিতিসম্পর্কিত বিভিন্ন আইন, কাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। অন্যদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পায়, তা সংকুচিত হবে। বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস সুবিধার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত হতে পারলে উত্তরণ-পরবর্তীকালে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক অব্যাহতি থেকে শুরু করে নানা ধরনের সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ২৭টি মানবাধিকার ও শ্রমমান-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক রীতি মানতে হবে, যার মধ্যে ১৫টি আইএলওর শ্রমমানের সঙ্গে সম্পর্কিত। সে জন্যই এই আলোচনা আয়োজন করে সিপিডি। উপস্থাপনায় সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা বস্তুত একধরনের বাণিজ্যিক কাঠামো। এটি পেতে হলে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়, শ্রম আইনের সংস্কার তার মধ্যে অন্যতম। মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা—এগুলোও লাগবে। তিনি আরও বলেন, শিশুশ্রম, ট্রেড ইউনিয়ন আইন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসহ শ্রম আইন ও অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ আছে। অনুষ্ঠানে শ্রমিকনেতারা শ্রম আইনের সুনির্দিষ্ট কিছু ধারা সংস্কারের কথা বলেন। শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। খাতভিত্তিক মজুরিকাঠামো আছে, তাও আবার সব খাতে নেই। এতে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। শ্রম আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ৩০ হাজার মামলা ঝুলে আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সব শিল্পাঞ্চলে শ্রম আদালত থাকা দরকার। তা না হলে শ্রমিকের পক্ষে মামলার শুনানিতে অংশ নেওয়া কঠিন। কারণ, এক দিন কারখানায় না গেলে তিনি মজুরি পাবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। ফলে শুধু আইন করলেই হবে না, দরকার বাস্তবায়ন। ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম মনে করেন, পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য শিল্পের বৈশ্বিক সংযুক্তি থাকায় আইন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেই তৈরি করতে হবে। তবে নিজেদের শ্রম পরিবেশের উন্নতি ঘটানোর জন্য কেবল বাইরের চাপের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, নিজেদেরও উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন উৎপাদনের বিরোধী শক্তি নয়। বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। দেশের প্রায় ৮৯ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাঁদের সাধারণত নিয়োগপত্র থাকে না। ফলে অধিকার নিশ্চিত করার মতো অবস্থা তাঁদের নেই। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভূমিকা পালনের কথা বলেন বক্তারা। পাশাপাশি শ্রম আদালতে কখন কোন মামলা চলছে, কী অবস্থায় আছে, তা জানার উপায় নেই। শ্রম অধিদপ্তর, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বেল্লাল হোসেন শেখ জানান, মন্ত্রণালয় ডেটাবেইস তৈরির কাজ শেষ করেছে। আগামী এক মাসের মধ্যে তা চালু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এতে ট্রেড ইউনিয়ন ও বিরোধ নিষ্পত্তিসম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত দ্রুত পাওয়া যাবে। এই পর্যায়ে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডেটাবেইসে শুধু মামলার খবরাখবর থাকলেই চলবে না, কোন মামলায় কী ছিল, কীভাবে ফয়সালা হলো, এসব তথ্যও থাকতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিস্ক এবং আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুওমো পটিয়াইনন সংলাপে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিঙ্ক বলেন, বাংলাদেশকে শ্রমিকবান্ধব একটি দেশ হিসেবে পরিচিত করা প্রয়োজন। শুধু জিএসপি প্লাস সুবিধা নয়, শ্রমিকদের সামগ্রিক উন্নয়নে এটি জরুরি। টুওমো পটিয়াইনন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ জোর দেন এবং জানান, শ্রম আইন ও অধিকার বিষয়ে সংলাপ চলমান রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ক্রেতাদের আরও দায়িত্ববান ভূমিকা পালন করতে হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ের শ্রমিক আইন মান্য করাতে ক্রেতাদের বৈশ্বিক পর্যায়ের দাম নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে এটি জরুরি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব শর্তের কথা বলছে, তার অনেক কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি কামরান টি আহমেদ, বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামিল প্রমুখ। জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে সিপিডির পরামর্শ হচ্ছে, শ্রম পরিদর্শকদের শূন্য পদে নিয়োগ, আইএলওর ২৯ ও ১৩৮ নম্বর ধারা অনুসমর্থন, বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন, কর্মক্ষেত্রে হয়রানির বিচার ইত্যাদি।