বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাঁচামাল খোলা বাজারে বিক্রি ঠেকাতে ২০১৯ সাল জুড়ে সাঁড়াশি অভিযান চালায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট একাধিক অফিস। বিশেষত রাজধানীর ইসলামপুর, নারায়াণগঞ্জের একাধিক পয়েন্ট, নরসিংদী এমনকি সিরাজগঞ্জেও অভিযানের পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা এমনকি অভিযুক্ত একাধিক গডফাদারকে গ্রেফতারও করা হয়। এরপর কিছুটা দমে যায় বন্ড চোরাকারবারী। এতে অনিয়ম কিছুটা কমে আসছিল। তবে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কিছুটা দম নিয়ে ফের সক্রিয় হয়েছে এই চোরাচালান চক্র। কেবল গত কয়েক মাসে কুমিল্লা ভ্যাট অফিসের কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়া ২১টি অনিয়মের মধ্যে ১৭টিই বন্ড সুবিধার পণ্যবাহী পরিবহন। এর মধ্যে আবার বেশির ভাগই তৈরি পোশাকের কাঁচামাল, অর্থাৎ কাপড়। চট্টগ্রাম থেকে বের হওয়া এসব পণ্যের বেশির ভাগেরই গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকার ইসলামপুর ও নারায়ণগঞ্জ। সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি বন্ড সুবিধায় আনা প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল, ছয় কাভার্ড ভ্যানভর্তি ৭৪ হাজার কেজি পিপি দানা খোলাবাজারে বিক্রির চেষ্টা শেষ পর্যন্ত প্রতিহত করেছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এর আগের মাসেই ডিইপিজেডের একটি বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে গার্মেন্টসের এক্সেসরিজের নামে আমদানিকৃত ১১ কোটি টাকা দামের সিগারেট ধরা পড়ে। আমদানির অনুমতিপত্র বা আইপি জালিয়াতির মাধ্যমে ঐ ঘটনা ঘটেছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। গত কয়েক মাসে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ এই ধরনের অপরাধে অন্তত ছয়টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মোংলা কাস্টম হাউজের হাতে ধরা পড়েছে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম। অভিযোগ উঠেছে, এসব প্রতিষ্ঠান বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় গার্মেন্টসের এক্সেসরিজ তৈরির কাঁচামাল এনে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ৪০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে। অপর একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরো ২২ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। সব মিলিয়ে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগে ছয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে মোংলা কাস্টম হাউজ। আর ঢাকার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস অন্তত আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এর মধ্যে ঢাকা ইপিজেডে অবস্থিত একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অনিয়মের মাধ্যমে ১৪৭ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে গিয়ে বন্ড কমিশনারেট এর কর্মকর্তারা দেখেন, চার বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১ কোটি ২৩ লাখ ১৫ হাজার গজ কাপড় আমদানি তা দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানি দেখিয়েছে। অথচ শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন, এসব কাঁচামাল ডিইপিজেডের গেটে এন্ট্রি করে কারখানায় প্রবেশ করার নিয়ম থাকলেও এসব পণ্য প্রবেশের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ইপিজেড নীতিমালারও বেশকিছু লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরে দেশের অন্যান্য কাস্টম হাউজেও বেশকিছু অনিয়ম ধরা পড়ার ঘটনা জানা গেছে। রপ্তানি আদেশের পণ্য তৈরির জন্য কাঁচামাল আমদানিতে বিপুল শুল্ককরের চাপ থেকে উৎপাদনকারীদের রেহাই দিতে সরকার ৮০’র দশকের শুরুর দিকে বন্ড সুবিধা চালু করে। অর্থাৎ রপ্তানিকারকরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করতে পারবেন। তবে শর্ত হলো ঐ পণ্য দিয়ে তৈরি পন্য শতভাগ রপ্তানি হতে হবে। স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হলে শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে। তৈরি পোশাকের কাঁচামালের শুল্ককর প্রায় ৮৯ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন হারে শুল্ককর রয়েছে। তবে এ সুবিধা পাওয়ার পর একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত প্রাপ্যতা দেখিয়ে (ইউটিলিটি ডিক্লারেশন বা ইউডি) কাঁচামাল আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে একই পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনকারীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। অন্যদিকে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বন্ড সুবিধার পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে বহু স্থানীয় বস্ত্রশিল্প ক্ষতির মুখে পড়ে। এ বিষয়টি নজরে আসার পর কঠোর অবস্থানে যায় এনবিআর। রাজধানী ইসলামপুর, নয়াবাজারসহ দেশের চোরাচালানের পয়েন্টগুলোতে এ ধরনের পণ্য বিক্রি ও সরবরাহ ঠেকাতে একটি আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ব্যাপক ধরপাকড়ের পাশাপাশি ৯টি ফৌজদারি মামলা হয়। গ্রেফতার হন চোরাচালান সিন্ডিকেটের নেতৃস্থানীয় তিন কর্তাব্যক্তি। তবে সম্প্রতি এনবিআরের কিছুটা নমনীয়তায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। ইতিমধ্যে গ্রেফতার হওয়া আসামিরাও জামিনে বের হয়ে গেছে। অন্যদিকে মামলাগুলোতে নির্দোষ প্রমাণ হতে অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বন্ড অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হোক। তবে যারা এ ধরণের অনিয়মকারী, তারা ‘ম্যানেজ করে’ ঠিকই আমদানিকৃত কন্টেইনার খালাস করতে পারে এ ধরণের পন্য খালাসের পেছনে তিনি আঙ্গুল তোলেন কাস্টম হাউজের শুল্ক কর্মকর্তাদের দিকে। তিনি বলেন, অথচ সামান্য ভুলের কারনে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের পণ্য আটকে রাখা হয় দিনের পর দিন।