স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের পর চীনা বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অতিরিক্ত ৫ বছর শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠেয় শুল্ক্ককাঠামো সংক্রান্ত এক বৈঠক থেকে এ ঘোষণা আসতে পারে। বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিআই) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এমন মন্তব্য করেছেন বেইজিংয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব-উজ্জামান। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি। গতকাল শনিবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এ ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএনসিডিপি) সর্বশেষ পর্যালোচনায় এলডিসি থেকে উত্তরণের সব যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকলে আগামী ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ। এই যোগ্যতা অর্জনের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুযায়ী এলডিসি হিসেবে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা থাকে না।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতির দেশ। ২০২৮ সালে দেশটি এক নম্বর অর্থনীতির দেশ হিসেবে উন্নীত হবে বলে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ দেশটির প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হতে চায় বাংলাদেশ। উদ্ভাবনী পণ্য, নতুন পণ্য ও প্রযুক্তি পণ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এখনও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রকিবুল হক বলেন, বড় বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আরও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক বন্ধন প্রয়োজন। বাংলাদেশে চীন এখন সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর দু’দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ব্যাপক হারে বেড়েছে।
রাষ্ট্রদূত মাহবুব-উজ্জামান আরও বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে বাংলাদেশের জন্য এফডিআই আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি এখন শক্তিশালী। ফলে এ দেশে চীনা বিনিয়োগের এখনই আদর্শ সময়। তিনি বলেন, করোনার কারণে এখন ই-বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে অনেক সাধারণ মানুষ। চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো ই-বাণিজ্যে বড় আকারের বিনিয়োগ করতে পারে।
আলোচনায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. এম আবু ইউসুফ এফডিআইর গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে যখন শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না, তখন কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে রপ্তানি বাজার নিয়ে। ওই অবস্থায় নতুন এবং উদ্ভাবনী পণ্য দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মতো দেশ চীনা বিনিয়োগেই টিকে আছে। বাংলাদেশকেও এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। এ পরিস্থিতি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আদর্শ।
অর্থনীতিবিদ এম এস সিদ্দিকী বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ছিটমহলের আদলে ‘চায়না টাউন’ নামে স্বতন্ত্র স্থাপনা আছে। বাংলাদেশে এখনও ‘চায়না টাউন’ গড়ে ওঠেনি। অথচ চায়না টাউনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে চীনা বিনিয়োগ যায়। এর মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশে পাদুকা শিল্পে চীনা বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চীনা অনেক উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ না থাকায় তারা শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ না করে ফিরে গেছেন। বড় হারের শুল্ক্ক দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। চীনের সঙ্গে এফটিএ আছে, চুক্তি আছে এমন দেশে বিনিয়োগ করছে চীনা উদ্যোক্তারা।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন এফডিআই সহজ এবং আকর্ষণীয় করতে সংস্থার বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। বিসিসিআই সভাপতি গাজী গোলাম মোর্তজা বলেন, বাংলাদেশ সাধারণত প্রচলিত পণ্যই বেশি উৎপাদন করে থাকে। তিনিও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী এবং প্রযুক্তি পণ্যে চীনা বিনিয়োগের সুযোগের কথা উল্লেখ করেন। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়নে উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের বিসিসিআইর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানান তিনি। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি এটিএম আজিজুল হক এবং অর্থনীতি বিশ্নেষক মাজেদুল হক।