বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি তৈরি পোশাকশিল্প। রপ্তানি, কর্মসংস্থান এবং নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকেও বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। এ খাত অর্থনীতির অন্যান্য অংশের সঙ্গে অতিমারিতে আক্রান্ত। এর ফলে শ্রমিকদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের সংকট দেখা গেছে। যারা এ খাতের উদ্যোক্তা, তারাও অর্থনৈতিক মন্দা এবং আর্থিক সংকটে বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ শিল্পে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব পরিবর্তন উৎপাদন কাঠামো, ভোক্তার চাহিদা, পণ্যের মিশ্রণ, বাজারের গতিশীলতা এবং আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত। অতিমারি-পূর্ব কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে অতিমারি-প্ররোচিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সবাইকে তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি দিতে বাধ্য করছে। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আসন্ন উত্তরণও এ শিল্পের ভবিষ্যৎ চিন্তার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
কভিড অতিমারির আগে থেকেই পৃথিবীর এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বেশ বড় ধরনের কিছু পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পোশাকের চাহিদা কাঠামোতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে কৃত্রিম তন্তুনির্ভর পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। ওভেন ও নিটওয়্যারের ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে। উৎপাদন কাঠামোর ভেতরে পরিবর্তন আসছে। বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। উৎপাদনে কৃত্রিম মেধার ব্যবহার হচ্ছে, রোবটের ব্যবহার হচ্ছে; সর্বোপরি ডিজিটাইজেশন হচ্ছে দ্রুত। একই সঙ্গে পণ্য প্রস্তুত করার যে চক্র তা ছোট হয়ে আসছে। উৎপাদন কাঠামোর মধ্যে এমন পরিবর্তন আসছে, যাতে বেশি পরিমাণে উপকরণ মজুদ না রাখতে হয় এবং অর্থনৈতিক কার্যকারিতা ও শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও ডিজিটাইজেশনের বিকাশমান প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক শ্রমিককে কাজ হারাতে হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচটি কর্মের জায়গায় দুটি কর্ম সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ অনেক কাজ তামাদি হয়ে যাবে। পণ্যের মান ও কৌশলেরও পরিবর্তন হচ্ছে।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের, বিশেষ করে তার শ্রমজীবী অংশের প্রস্তুত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কভিডকালে শ্রমিকের অবস্থা
গত জুন মাসে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের একটি খানাভিত্তিক মুখোমুখি জরিপ পরিচালনা করা হয়। গার্মেন্ট কারখানা অধ্যুষিত চারটি জেলা ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের ৫০০ খানার ওপর এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। অতিমারির প্রাদুর্ভাবে পোশাকশিল্প ও শ্রমিকদের অবস্থা এ জরিপে উঠে আসে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় তাদের জীবন কীভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে, যা এ খাতের ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জরিপের ফলাফল বলছে, কভিডের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রমিকদের একটি অংশ আংশিক বেতন বা বোনাস পেয়েছে। অনেকের ওভারটাইম কমে গেছে। কিছু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এবং তাদের একটি অংশ এখনও কাজে ফেরত যেতে পারেনি। দেখা গেছে, অনেক শ্রমিক আগের মতো ব্যয় করতে পারছেন না। তাদের প্রোটিন গ্রহণের হার কমে গেছে। কাজ হারিয়েছেন যারা, তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন, সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন। অনেকে বলেছেন, তাদের সাহায্যের দরকার ছিল। কিন্তু ব্যক্তি বা সরকারি উদ্যোগের সহায়তা তেমন পাননি। যারা কাজ হারিয়েছেন, তাদের অনেকেই বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ সহায়তা তহবিল থেকে তারা সহায়তা পাননি।
যদিও সম্প্রতি তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক সংলাপে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা নেই বললেই চলে। তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে একটি অংশ কেটে নিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় পোশাক শ্রমিকদের কল্যাণে যে তহবিল গঠন করেছে, কভিডের সময় সেখান থেকেও কোনো সহায়তা শ্রমিকরা পাননি।
জরিপ থেকে দেখা যায়, বাজার ব্যবস্থা ও অতিমারির কারণে শ্রমিকরা যে সংকটের মধ্যে রয়েছেন, তাদের জন্য আপৎকালীন তহবিলের ব্যবস্থা করতে হবে। আপৎকালীন সুবিধার পাশাপাশি তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা প্রয়োজন অনেক বেশি। এ জন্য ভবিষ্য তহবিলের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কর্মজীবন শেষ হলে তারা জীবন চালানোর মতো আর্থিক সুরক্ষা পায়। এর পাশাপাশি তাদের জন্য সর্বজনীন বীমা সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিবর্তন ঘিরে ভাবনা
পোশাক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মধ্যমেয়াদি প্রবণতা বিবেচনায় নিতে হলে ঘনায়মান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উন্মেষ ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অবশ্য যে ধরনের দক্ষতা দরকার হবে, তার সবটা বর্তমান শ্রমিকদের দিয়েই হবে, এমন মনে করছেন না উদ্যোক্তারা। শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী ও স্বল্প শিক্ষিত একটি অংশকে হয়তো এ খাত থেকে চলে যেতে হবে। অপরদিকে পোশাক খাতের বিভিন্ন অনুষঙ্গ সরবরাহ খাতে এবং হালকা প্রকৌশল খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটুকু তা পরিস্কার নয়।
এদিকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে ২০২৬ সালে বের হয়ে গেলে বাংলাদেশ ইউরোপীয় বাজারে তিন বছর পর শুল্ক্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে। এর পর বাজার সুবিধা পেতে হলে বিদেশ থেকে কাপড় এনে সেলাই করলে হবে না; সুতা এনে কাপড় বানিয়ে পোশাক তৈরি করতে হবে। কৃত্রিম তন্তুর বৈশ্বিক চাহিদা বাড়ার সঙ্গে আমরা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারছি কিনা, সে বিষয়টিও ভবিষ্যতের আরেক চিন্তা। পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের প্রসারে যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে, যেখানে রাষ্ট্রের নীতিগত ও অন্যান্য সহায়তা দরকার।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ তার অংশীদারিত্ব যেভাবে বাড়াতে পেরেছে, আগামীতে সে সম্ভাবনা কমে আসছে। এর অন্যতম কারণ ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া। বাংলাদেশ যখন ২০২৯ সালে ইউরোপীয় বাজার সুবিধা হারাবে, তখন ভিয়েতনাম সেখানে পুরোপুরি শুল্ক্কমুক্ত সুবিধায় পোশাক রপ্তানি করবে। ভিয়েতনামের পোশাক খাতে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবে তারা আমাদের চেয়ে অগ্রসর। সুতরাং তাদের কাছে ইইউর বাজারে বর্তমান অংশ হারানোর সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশকে এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং পণ্য বৈচিত্র্যের দিকে যেতে হবে।
শুধু ইইউর বাজার নয়, সব বাজারে আগামীতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও ভূমিকা নিতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, সমন্বিত অংশীদারিত্ব চুক্তির মতো বিভিন্ন উদ্যোগে যুক্ত হয়ে অগ্রাধিকার বাণিজ্যের সুবিধা নিতে হবে।
তবে ইউরোপীয় তথা বৈশ্বিক বাজার ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে অতি প্রয়োজনীয় হলো শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানার অবকাঠামো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখনও কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের যৌথ দর কষাকষির অধিকার সীমিত। পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোও বিভক্ত। কোনো একক ইউনিয়নের মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ব্যবস্থা নেই। শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবের কথাও বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসছে। এ শিল্পের ভবিষ্যতের সঙ্গে শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নতি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে সব পক্ষের মনোযোগ বাড়াতে হবে।
অটোমেশন বা যন্ত্রায়নে যে ধরনের দক্ষতা ও শিক্ষা দরকার, তার জন্য চোখে পড়ার মতো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা সেভাবে নেই। শ্রমিকদের সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্র, উদ্যোক্তা গোষ্ঠী এবং ক্রেতাদের যৌথ অংশীদারিত্বমূলক ভূমিকা নিতে হবে। অপরদিকে বিদেশি ক্রেতারা শ্রম অধিকার বা অন্যান্য শর্তের ব্যাপারে যতটুকু মনোযোগী, পণ্যের দর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সে মনোযোগ দেখা যায় না। ক্রেতাদের এ মনোভাব পরিবর্তনে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার দরকার। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অর্থনৈতিক কূটনীতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলোকেও ভূমিকা নিতে হবে।
সমাপনী চিন্তা
বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার জন্য বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতির দরকার। ব্যক্তি খাতের সক্ষমতা বাড়ানোরও দরকার রয়েছে এবং এর চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শ্রমিকের অবস্থান কী হবে। তার স্থিতিসত্তা এবং অধিকার বাস্তবায়ন পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে কী হবে। যে শ্রমিকরা ইতোমধ্যে আছেন এবং আগামীতে যারা আসবেন তাদের আয়, মজুরি ও প্রকৃত আয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে তাদের আয়বহির্ভূত বিভিন্ন সুবিধার দিকেও মনোযোগ দেওয়া দরকার। নতুন প্রজন্মের শ্রমশক্তিতে যারা আসবে, তাদের শুধু আয়ের দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না; শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক সক্ষমতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। আর নতুন প্রজন্মের এই উচ্চতর সক্ষমতাসম্পন্ন শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ হতে হবে সবচেয়ে বেশি।
শ্রমিকের যে সামাজিক অধিকার রয়েছে- শ্রমিক হিসেবে সংঘবদ্ধ হওয়া এবং তার দর কষাকষির যে অধিকার, তা নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী দিনের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে পিছিয়ে পড়তে হবে। তৈরি পোশাক খাত আগামী দিনে অনেক বেশি উৎপাদনশীল, প্রযুক্তিনির্ভর ও ডিজিটাইজড হবে এবং শ্রমিকদের আয়ও হয়তো বাড়বে। কিন্তু নারীর কর্মসংস্থান ঠিক একইভাবে হবে কিনা এবং তারা শিক্ষা ও উপযুক্ততা নিয়ে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা, এটাই বড় চিন্তা।
কাজেই প্রস্তুতির জায়গায় নারী শ্রমিকদের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। ফলে পুরোনা জায়গায় নতুনভাবে এবং নতুন জায়গায় নতুনভাবে নারী শ্রমশক্তি যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। তাই আগামী দিনের পোশাকশিল্পের জন্য নারী শ্রমিকদের কার্যকরভাবে দাঁড় করানোই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক
প্ল্যাটফর্ম ও সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি