আমাদের চামড়া শিল্প বহু পুরানো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকেই চামড়া ব্যবসায় আমরা ভালো করে আসছি। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে কোরবানির সময় কাঁচা চামড়া ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা মোটেই এই শিল্পখাতের জন্য শুভ নয়। চা, পাট, চামড়া এই তিনটি শিল্পখাতের মৌলিক কাঁচামাল আমাদের দেশে রয়েছে। পক্ষান্তরে রপ্তানির ৭৮ শতাংশের অধিকারী তৈরি পোশাক শিল্পের পুরো কাঁচামাল এখনও দেশে উৎপাদিত হয় না। নিজস্ব কাঁচামাল থাকার পরও আমাদের চা, পাট ও চামড়া শিল্পের উন্নতি চোখে পড়ার মতো হয়নি। দিন দিন এই তিনটি খাত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে।
ইতিহাসের কথা: মানব সৃষ্টির পর থেকে জুতার ব্যবহার ছিল। হয়তো আজকের মতো তত সুন্দর জুতা ছিল না। কিন্তু জুতা ছিল। তখন গাছের ছাল, পশুর চামড়া দিয়ে মানুষ জুতা তৈরি করে ব্যবহার করতো। আমাদের মহানবী (সা.) ব্যবহৃত চামড়ার জুতা আজও তুরস্কের যাদুঘরে দেখা যায়। খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দিতে গুহায় বসবাসরত মানুষ এক ধরনের চামড়ার জুতা ব্যবহার করত বলে প্রমাণ রয়েছে। বর্তমানের মতো ফিতাযুক্ত চামড়ার জুতা আবিষ্কৃত হয় ১৭৯০ সালে। তখন ইউরোপের অভিজাত মানুষ বিভিন্ন নকশার এই জুতা পরতেন।
বর্তমান কালে: নানা কারণে চামড়ার জুতার স্থান দখল করে নিচ্ছে অন্য কাঁচামাল দিয়ে তৈরি জুতা। বিশেষ করে সিনথেটিক, রাবার, প্লাস্টিক, কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে তৈরি জুতা। চামড়ার চেয়ে সস্তা ও টেকসই হওয়ার কারণে ভোক্তারা চামড়াবিহীন জুতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে চামড়াবিহীন জুতার বাজার বিশ্বে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে এর অবস্থান: বাংলাদেশ চামড়া উৎপাদনকারী দেশ। বিদেশে চামড়া আমরা রপ্তানিও করে থাকি। তারপরও চামড়াবিহীন জুতা-উৎপাদন ও রপ্তানি বাংলাদেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য আজও আমাদের দেশ থেকে চামড়ার জুতাই রপ্তানি হয় বেশি। চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি বিগত সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২২টি প্রতিষ্ঠান সিনথেটিক, রাবার, প্লাস্টিক, কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে জুতা উৎপাদন ও রপ্তানি করছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছর ৯১ কোটি ডলার অর্থাৎ ৭ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার জুতা রপ্তানি হয়েছে। তারমধ্যে চামড়াবিহীন জুতা থেকে এসেছে ৩৪ কোটি ডলার অর্থাৎ ২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এই আয় ছিল মাত্র অর্ধেক, ১৭ কোটি ডলার। গত বছর চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্বজুড়ে চামড়াবিহীন জুতার বাজার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনাকারণে মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। খরচ করার ক্ষমতা মানুষের হ্রাস পেয়েছে। তাই এ খাতের রপ্তানি বাড়বে। বাংলাদেশে চামড়াবিহীন জুতার উৎপাদন মাত্র শুরু হয়েছে। অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে। এই খাতের কাঁচামাল শত ভাগ আমদানিনির্ভর। সরকার বিশেষ নজর দিলে, নীতি-সহযোগিতা প্রদান কারলে এই খাতে দেশি-বিদেশি উদোক্তাগণ এগিয়ে আসবে, রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।
জুতার বিশ্ব বাজার: তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে বিশ্বে প্রত্যেক মানুষের জন্য গড়ে ৩ দশমিক ১ জোড়া জুতা তৈরি হয়েছিল। তাতে মোট জুতা উৎপাদন হয়েছিল ২৪ হাজার ২০০ কোটি জোড়া। এই জুতার মূল্য ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়াচ্ছে ৩১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি।
ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যারের তথ্যানুযায়ী, করোনাকারণে জুতার বাজার কিছুটা কমেছে। গত বছর ২০২০ সালে জুতা উৎপাদিত হয়েছে ২ হাজার ৩০ কোটি জোড়া। তা থেকে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২১০ কোটি জোড়া। তবে করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে, জুতার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সালে বিশ্বে জুতার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ৩ হাজার কোটি ডলারে হবে।
কোন দেশ কত ব্যবহার, রপ্তানি: জুতা ব্যবহার সংখ্যার উপর নির্ভর করে। পৃথিবীতে প্রতিদিন মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই জুতার ব্যবহারও বাড়ছে। দেশের জনসংখ্যা ও রপ্তানিতে চীন পৃথিবীর সবার উপরে। তাদের ব্যবহারও বেশি, রপ্তানিও করে বেশি। গত বছর ২০২০ সালে চীনারা জুতা ক্রয় করেছে ৩৯৪ কোটি জোড়া জুতা। দ্বিতীয়স্থানে থাকা ভিয়েতনাম ব্যবহার করেছে ২০০ কোটি জোড়া। গত বছর ৩৬ কোটি জোড়া জুতা বাংলাদেশ কিনে স্থান পেয়েছে নবম। চীন ২০২০ সালে জুতা রপ্তানি করেছে ৭৪০ কোটি জোড়া, যা বিশ্বের রপ্তানির ৬১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। রপ্তানি করেছে ১২৩ কোটি জোড়া। ভিয়েতনাম বিশ্বের বাজারের ১০ শতাংশ দখল করে আছে। এই দুই দেশের পর শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়ায়, জার্মান ও তুরস্ক।
তিন দেশের জুতার ধরন: বাংলাদেশ: রাবার ও প্লাস্টিক: ২২%, কাপড় ৩৫%, চামড়া ৪২%, অন্যান্য ১%। চীন: রাবার ও প্লাস্টিক: ৫৬%, কাপড় ৩১%, চামড়া ৭%, অন্যান্য ৬%। ভিয়েতনাম: চামড়া ২৩%, কাপড় ৪৮%, অন্যান্য ৪%, রাবার ও প্লাস্টিক ২৫%।
বিশ্বে রপ্তানি কমেছে চামড়ার তৈরি জুতার, চাহিদাও কমেছে। ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যারের তথ্যনুযায়ী, বিশ্বে ২০০৯ সালে রপ্তানি হওয়া মোট জুতার ১৯ শতাংশ, পরবর্তী দুই বছর সেই ধারা অব্যাহত ছিল। মূল্য বেশি হওয়ার কারণে ২০১৮ সালে অর্থের হিসাবে রপ্তানি হওয়া মোট জুতার ৩৯ শতাংশ ছিল চামড়ার। আর ৬১ শতাংশ ছিল চামড়াবিহীন জুতার। এর অর্থ হচ্ছে গত বছর ২০২০ সালে প্রায় ৭৫০ কোটি ডলারে চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি হয়েছে। দেশীয় অর্থে ছাড়াচ্ছে ৬২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা সমমানের।
চামড়াবিহীন জুতার মধ্যে রাবার ও প্লাস্টিকের তৈরি জুতার চাহিদা সব চেয়ে বেশি। ২০১৮ সালে মোট রপ্তানির ৪৭ শতাংশই ছিল রাবার ও প্লাস্টিকের। এই ক্ষেত্রে কাপড়ের তৈরি জুতারও চাহিদা রয়েছে। কাপড়ের তৈরি জুতা ছিল ৩২ শতাংশ। বিগত এক দশক কাপড়ের তৈরির জুতার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবাক করেছে ভিয়েতনাম: ভিয়েতনাম তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। তেমনি তারা জুতা রপ্তানিতেও বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। মাত্র সাত/আট বছরের মধ্যে ভিয়েতনামের পাঁচগুণ জুতা রপ্তানি বেড়েছে। তথ্য অনুয়ায়ী দেখা যায়, ২০১৩ সালে ভিয়েতনাম ৪২২ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি করে। ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ১১৬ কোটি ডলারের হয়েছে।
২০১১ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা সমান সমান রপ্তানি করেছে। বিশ্বের চাহিদার কারণে ভিয়েতনামের উদ্যোক্তাগণ চামড়াবিহীন জুতা উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। বর্তমানে তাদের মোট রপ্তানির ২৩ শতাংশ চামড়ার জুতা এবং ৪৮ শতাংশ কাপড়ের জুতা। রাবার ও প্লাস্টিক জুতা রপ্তানি হয় ২৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে ভিয়েতনাম ১ হাজার ৬২৯ কোটি ডলারের চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি করেছে।
বাংলাদেশের অবস্থান: বিশ্ব বাজারে জুতা রপ্তানির হিস্যার মাত্র এক শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চামড়ার জুতার পাশাপাশি চামড়াবিহীন জুতার উৎপাদন বৃদ্ধি করছে। কিন্তু আমরা চামড়া ও চামড়াবিহীন উভয় খাতে উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের নিজস্ব কাঁচামাল চামড়া থাকা সত্তে¡ও এই খাতের উজ্জ্বলতা নাই। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তেমন চোখে পড়ছে না এ খাতে। বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়া ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে কিছু অপতৎপরতা দেখা যায় কুরবানির সময়। নানা কারণে আজও আমাদের চামড়া শিল্প খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর হওয়ার পর শিল্পে গতি আসে নাই। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান এখনও সাভারে চালুও করতে পারেনি।
করণীয়:
১. আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। দেশকে শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পের উপর নির্ভর করে চলতে দেয়া উচিত নয়। রপ্তানি পণ্যের তালিকা দীর্ঘ করা প্রয়োজন। এক সময় চামড়া শিল্প রপ্তানিতে প্রথম ছিল। এখন অনেক পিছিয়ে গিয়েছে। চামড়ার বিকল্প এখন চামড়াবিহীন জুতা বিশ্ব জুড়ে প্রচুর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের তাল মিলাতে হবে। দেরি করলে বাজার অন্য দেশে চলে যাবে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বাজারের অনেকাংশ দখল করে ফেলেছে। আমাদের চেষ্টার কমতি রয়েছে। চেষ্টার গতি ও পরিকল্পনা দীর্ঘ করা প্রয়োজন।
২. নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এই খাতে আনতে হবে। তাই সরকারকে বিশেষ নীতি-সহযোগিতা ঘোষণা করতে হবে। তবেই দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।
৩. এই খাতের জন্য নগদ সহায়তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৪. একশত রপ্তানি অঞ্চলের মধ্য থেকে যে কোনো একটিতে চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা শিল্প অঞ্চল ঘোষণা করা প্রয়োজন। তাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ সহজ্রে দ্রুত আসবে।
৫. চামড়া শিল্পের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সাভারে স্থানান্তরিত চামড়া শিল্পের মৌলিক সমস্যা বর্জ্য অপসারণ। তা না হলে বুড়িগঙ্গার মতো উক্ত নদীও ব্যববহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে সংসদীয় কমিটি সাভারে চামড়া শিল্প বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব করেছে। কিন্তু বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান নয়, বরং সমস্যা সমাধান করাই মূল কাজ।
৬. চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য তার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও আনুষাঙ্গিক অন্যান্য পণ্য যোগানের ব্যবস্থা করা দরকার। তার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এই ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগই হতে পারে অন্যতম সমাধান।
লেখক: প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।