Home বাংলা নিউজ মহাসড়কে রপ্তানির পোশাক চুরি বাড়ছে

মহাসড়কে রপ্তানির পোশাক চুরি বাড়ছে

মহাসড়কে গার্মেন্টস পণ্য চুরির বিষয়টি রপ্তানিকারকদের কাছে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে পণ্যবাহী লরি থেকে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে এই ধরনের চুরি বেড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানিকারকরা উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। পাশাপাশি বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে।

শিল্প মালিকরা এই ধরনের চুরি প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে মহাসড়কে নজরদারি ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন। কারণ, এতে করে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের এই খাতের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে আপস করতে হচ্ছে।

প্রতিকার খুঁজতে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা গত জুলাই মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন চুরি ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়ার নিশ্চয়তার পাশাপাশি ৪ মাসের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর আশ্বাস দেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে, বিশ্ববাজারে চীনের পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। সে বছর ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের বৈশ্বিক গার্মেন্টস পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ অংশ ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বারবার চুরির ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতের সুনাম নষ্ট হতে পারে। ক্রয়াদেশ বাতিল হতে পারে। যার প্রভাব পড়তে পারে দেশের রপ্তানি আয়ের ওপর।

হুমকিতে পোশাক খাত

পোশাক চুরির সঙ্গে সংঘবদ্ধ চক্র বোকা বানানোর দারুণ একটা ব্যবস্থা তৈরি করেছে। যার ফলে হারানো পণ্য সম্পর্কে ক্রেতারা রপ্তানিকারকদের অবহিত না করা পর্যন্ত তারা সেটা জানতেও পারেন না। কখনো কখনো চালান যাওয়ার কয়েক মাস পর সেটা জানা যায়। যা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে।

তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক গুণমান ও পরিমাণগত নিরীক্ষার পর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পোশাকের চালান পাঠানোর জন্য রপ্তানিকারকরা পরিবহন সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিবহন সংস্থাগুলো তখন লরি ভাড়া করে।

গোয়েন্দাদের ভাষ্য, কারখানায় লোডিং সম্পন্ন হওয়ার পর এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অংশীদার লরি চালকরা চালান, রুট ও সময় সম্পর্কে অন্যদের বার্তা দেয়।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুসারে পণ্যবাহী যান মহাসড়কের কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় থামে। সেখান থেকে তা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, কুমিল্লার চান্দিনা, ফেনী, মিরসরাই ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গোপন গুদামে নেওয়া হয়।

সেখানে চক্রগুলো পণ্যবাহী যানের দরজায় লাগানো তালার সিল খুলে ভরা কার্টনের নিচ থেকে কিছু পোশাক বের করে নেয়। পরে খালি অংশ বালু, ন্যাকড়া এমনকি কাদা দিয়ে পূর্ণ করে পুনরায় সিল করে দেওয়া হয়।

এই ধরনের চুরির শিকার বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারক ক্রেতাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন। তারা জানান, পোশাক বের করে নেওয়ার পর সেগুলো আবার এত সুন্দরভাবে প্যাকেটজাত করা হয় যে, বিদেশি ক্রেতারা কার্টন না খোলা পর্যন্ত কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

গোয়েন্দাদের বক্তব্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালানের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পোশাকও চুরি হয়। যা খুব কম দামে স্থানীয় বাজারে কিংবা কিছু অসাধু বিদেশি ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়।

বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ধরা যাক একটা ভালো মানের টি-শার্ট কালোবাজারের ৩ ডলারে বিক্রি করা হলো। যা এর ১০ ডলার রপ্তানিমূল্যের অনেক নিচে।

গোয়েন্দারা এই ধরনের অন্তত ৮টি চক্রকে চিহ্নিত করেছে। আর এসব অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশ জানায়, ২০ বছর ধরে এই ধরনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত শাহেদ নামের এক ব্যক্তি এমন একটি চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে। যিনি সাইদ নামেও পরিচিত। গত ১২ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এ ধরনের দুটি চুরির ঘটনায় মামলা দায়েরের পর শাহেদকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গোয়েন্দা বিভাগের তেজগাঁও ডিভিশনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা বলেন, ‘চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারের জন্য আমরা অভিযান চালাচ্ছি।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে যে কিছু বিদেশি ক্রেতা চুরির পোশাক কেনার জন্য বাংলাদেশে আসে।

চুরি বাড়ছে

বিজিএমইএর তথ্য অনুসারে, মহাসড়কে চুরির ঘটনা বাড়ছে। ২০১৯ সালে এই ধরনের ২টি ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে এমন ৯টি ঘটনা ঘটে। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এমন ২২টি ঘটনা ঘটেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুরির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ ক্রেতাদের আস্থা হারানো ও সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ হারানোর ভয়ে অনেক রপ্তানিকারক বিষয়টা তাদের জানান না। 

মে মাসে আশুলিয়ার জয়ন্তী নিটওয়্যার লিমিটেড চালানের জন্য লরিতে করে ২৮ হাজার ৩২০ পিস গার্মেন্টস পণ্য চট্টগ্রামে পাঠায়।

জয়ন্তী নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) বুলবুল আহমেদ জানান, কিন্তু বিদেশি ক্রেতা দেখতে পান চালানে ১১ হাজার পিস পণ্য কম আছে। এ অবস্থায় চুক্তির বাইরে গিয়ে কম পণ্য পাঠানোর জন্য তাদের ২৮ হাজার ৯০৮ ডলার জরিমানা করা হয়।

বুলবুল আরও জানান, গত মাসে কোম্পানির পক্ষ থেকে পণ্যবাহী যানের চালক ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর চালক আদালতে চুরির বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

১৩ আগস্ট র‌্যাব নারায়ণগঞ্জের পরিত্যাক্ত একটি স্টিল মিল থেকে অন্য একটি চক্রের  ৬ সদস্যকে আটক করে। সেখান থেকে ৪১ বস্তা ও ৫০৬টি কার্টনভর্তি চুরি যাওয়া গার্মেন্টস পণ্য উদ্ধার করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা।

তখন র‌্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া) খন্দকার আল মঈন জানিয়েছিলেন গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকার করেছেন যে, তারা দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানির পোশাক চুরির সঙ্গে যুক্ত।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে র‌্যাব দুটি পৃথক অভিযানে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা থেকে গার্মেন্টস পণ্য চুরির সময় ১৬ ব্যক্তিকে হাতেনাতে ধরে।

একজন ‘ধনী চোর’

চুরির কারণে একদিকে রপ্তানিকারকরা লোকসান গুণে যাচ্ছেন। অন্যদিকে চুরির পণ্য বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্য বদলে ফেলছে চক্রের কিছু সদস্য।

কথিত গ্যাংলিডার শাহেদ এমনই একজন।

১৭ সেপ্টেম্বর শেষবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে শাহেদ সম্পর্কে বলেন, শাহেদ সিলেটি সাইদ নামেও পরিচিত। গত ২১ বছরে শাহেদ ও তার দলের সদস্যরা ৫ হাজার ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে পণ্য চুরি করেছে।

এই ধরনের ‍চুরির ঘটনায় বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৪টি মামলা হয়েছে। গত বছর বন্দর নগরীতে দায়ের করা ৬টি মামলায় তিনি ৮ মাস কারাগারে ছিলেন।

অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, জামিনে বের হয়ে আসার পর শাহেদ আবার তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, সিলেটে শাহেদের ‍২টি বাড়ি ও ১টি ইটভাটা আছে। চট্টগ্রামের ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির কয়েক জন নেতা বলেন, শাহেদ ২৯টি লরির মালিক।

চুরি থেকে প্রাপ্ত অর্থ চক্রের সব সদস্যের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রতি অভিযানে ড্রাইভার ১৫ হাজার টাকা ও সহকারী ১২ হাজার টাকা পায়। চক্রের নেতা ‍চুরির বেশিরভাগ অর্থ পকেটস্থ করে।

বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক অ্যান্ড প্রাইভ মুভারস পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জাফর আহমেদ স্বীকার করেছেন যে, কিছু চালক ও ট্রাক মালিক হাইওয়েতে গার্মেন্টস পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত।

জুলাই মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় পুলিশ কারখানা মালিকদের সম্ভব হলে নিজেদের ট্রাকে করে কিংবা পুলিশ প্রহরায় পণ্য পাঠানোর পরামর্শ দেয়। একই সঙ্গে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ট্র্যাকারের মাধ্যমে পণ্যবাহী যান নজরদারির কথা বলে।

এই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে ১টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here