দেশের সিনথেটিক ও অ্যাথলেটিক জুতা রপ্তানির পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাকের ব্যাপক আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে নতুন খাত হিসেবে নন-লেদার জুতার রপ্তানি বেড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে সুখবর।
২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হওয়ার আগের দশকে নন-লেদার জুতার রপ্তানি ১২০ শতাংশ বেড়ে ১৮৯ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪১৬ মিলিয়ন ডলার হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছে, চলতি অর্থবছরেও এই খাতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
ইপিবির তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নন-লেদার জুতা রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেড়ে ২১৭ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলারে হয়েছে।
রপ্তানিকারকরা আশা করছেন, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ চামড়ার জুতা, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও কৃষিপণ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নন-লেদার জুতা শিল্প অর্ধ বিলিয়ন ডলারে প্রবেশ করবে।
শোয়েনিভার্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পশ্চিমের ক্রেতারা পণ্যের তালিকায় বৈচিত্র্য আনতে ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের ওপর বড় ধরনের শুল্ক এড়াতে শীর্ষ জুতা উৎপাদক চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।’
ময়মনসিংহে রিয়াদ মাহমুদের জুতা কারখানায় প্রায় চার হাজার ৭০০ জন কাজ করেন। সেখান থেকে ইন্ডিটেক্স, আলদি, মাতালান ও রেডটেপের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য জুতা পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি বহুমুখীকরণের চেষ্টা করলেও এখনো মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে।
রিয়াদ মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখানে কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায়। এ দেশের তৈরি পোশাক সম্পর্কে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো ভালোভাবে অবগত। তারা এখন জুতার অর্ডার দিতে উৎসাহী হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম খরচ কম হওয়ায় ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশি কারখানাগুলো সিনথেটিক জুতার প্রতিযোগিতামূলক দাম দিতে পারে। ফলে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও নতুন ক্রেতারা আকৃষ্ট হচ্ছে।’
‘বড় ব্র্যান্ডগুলো আগামী মার্চ পর্যন্ত শোয়েনিভার্সের কারখানা বুকিং দিয়েছে। চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ শুল্ক আরোপের সম্ভাবনার কারণে ক্রেতারা এখন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।’
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে—এইচঅ্যান্ডএম, পুমা, ডেকাথলন, ফিলা ও কাপ্পার মতো ব্র্যান্ডগুলোর কার্যাদেশ বেড়ে যাওয়ায় নন-লেদার জুতার রপ্তানি বেড়েছে।
নন-লেদার জুতার প্রধান বাজার স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ইতালি ও জার্মানি।
চামড়ার চেয়ে ভালো
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গত ১০ বছরে দেশের নন-লেদার জুতা রপ্তানি গড়ে বার্ষিক ২৩ শতাংশ হারে বেড়েছে। চামড়ার জুতা রপ্তানি প্রবৃদ্ধি মাত্র ছয় শতাংশ।
চামড়ার জুতা রপ্তানি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৮৩ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৪৪ মিলিয়ন ডলার হয়েছে।
তবে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নন-লেদার জুতা রপ্তানিকারকরা মাত্র চার শতাংশ নগদ প্রণোদনা পান জানিয়ে রিয়াদ মাহমুদ আরও বলেন, ‘চামড়ার জুতা খাতে তা ছিল ১৫ শতাংশ।’
নন-লেদার জুতা রপ্তানির ভবিষ্যৎ
এডিসন ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া শহীদ মনে করেন, দ্রুত প্রবৃদ্ধির কারণে নন-লেদার জুতা শিল্প ভবিষ্যতে রপ্তানি বহুমুখীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবে সময় মতো পণ্য পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ায় নাইকি ও অ্যাডিডাসের মতো শীর্ষ ব্র্যান্ড বাংলাদেশে আসেনি।
ফ্রান্স ও জার্মানিতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মাফ সুজের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ শাহাদাত উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ক্রেতারা বেশি অর্ডার দেওয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের রপ্তানি বেড়েছে।’
টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মাফ সুজের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ হাজার জোড়ারও বেশি।
দেশে অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০২১ সাল থেকে আরএফএল নন-লেদার জুতা রপ্তানি শুরু করে। বর্তমানে ৩৭ দেশে আমাদের জুতা রপ্তানি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিপুল চাহিদা এবং দ্রুত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বিবেচনায় এ খাতটি দ্রুত অন্যতম প্রধান রপ্তানি আয়কারী খাত হিসেবে সামনে আসতে পারে।’
প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে
জেনিস সুজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির খান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে উচ্চ শুল্ক এড়াতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।’
‘শুল্ক কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছি।’
‘স্থানীয় উৎপাদকদের এখন আলোচনা করতে ও রপ্তানি আদেশ পেতে কমপক্ষে সাড়ে তিন মাস লাগবে,’ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘চামড়া ও নন-লেদার জুতার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সত্ত্বেও শুল্ক কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে গত দুই দশকে রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারে আটকে আছে।’
তার ভাষ্য, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে বছরে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা আমদানি শুল্ক পেয়ে থাকে। বন্ডেড ওয়্যারহাউজে কাঁচামাল আনতে হয়।
কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুল্ক কমিয়ে দিলে ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজের শর্ত ছাড়া কাঁচামাল আমদানির অনুমতি দিলে সরকারের রাজস্ব বহুগুণ বাড়তে পারে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাভারের ট্যানারি শিল্পে কমপ্লায়েন্স না থাকায় চামড়ার জুতা রপ্তানি বাড়াতে কারখানার মালিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। নন-লেদার জুতা শিল্পে এ ধরনের সমস্যা নেই। তাই রপ্তানি বেড়েছে।’
বিশ্ববাজার গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সিমাইজ মার্কেট রিসার্চের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী অ্যাথলেটিক জুতার বাজারমূল্য ছিল ৬৮ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
২০৩০ সালের মধ্যে এই বাজার বছরে সাত দশমিক ১১ শতাংশ হারে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।