ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়াটা বর্তমানে ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। এ ‘বিচ্ছেদ’ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে পাউন্ড ও ইউরোর দরপতন ঘটে। এতে বাংলাদেশের রফতানিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশের পুঁজিবাজারেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। এছাড়া অভিবাসন, রেমিটেন্স, কর্মসংস্থানসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে নানা অসুবিধা ও সংকট দেখা দিতে পারে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার যুগান্তরকে এমন আশংকার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার। পাশাপাশি আমদানি-রফতানিকারকদের মতে, ব্রিটেনের এ পট পরিবর্তনের ফলে ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রফতানি। এছাড়া অভিবাসনে কিছুটা অভিঘাত আসতে পারে। পুঁজিবাজারেও আংশিক প্রভাব পড়বে। তবে বিদেশী বিনিয়োগ বেশি নেই বলে বড় কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, কাজটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়নি। সাময়িকভাবে কিছু অসুবিধা হতে পারে। ব্রিটেনের ভেতর দিয়ে ইউরোপের বাজারে আমাদের যেতে হয়। আশা করি, তারা বাধা দেবে না। পাউন্ড দুর্বল হলে আমাদের সক্ষমতা কমে যায়। এ ঘটনায় ইউরোর দামও কমে যেতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সরকারকে দ্রুত স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, এ সিদ্ধান্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। কারণ, দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ পোশাক রফতানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে। এক্ষেত্রে সতর্ক পর্যবেক্ষণ রাখার পরামর্শ দেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, পুুঁজিবাজারে কিছুটা অস্থিরতা আসতে পারে। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রফতানি খাত।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে এমনিতে মন্দা চলছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়াটা তার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ হল। তার মতে, পোশাক খাতে এর প্রভাব বেশি পড়বে। অবিভক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের পোশাক খাতের চুক্তি ছিল। তা এখন নবায়ন করতে হবে। এক ধরনের টানাপোড়েন লেগে থাকতে পারে। সহসাই সমস্যাটির সমাধানও হচ্ছে না। কারণ যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার এ ঘোষণা কার্যকর হতে কমপক্ষে ২ বছর সময় লাগবে। কূটনৈতিক চতুরতার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জিল্লুল হাই রাজী বলেন, ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসা খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে সমঝোতা করতে হবে। নতুন করে আইনকানুন করার প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে ব্রিটেনে গণভোট অনুষ্ঠিত হলেও এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে আরও অন্তত ২ বছর লাগবে। তিনি বলেন, আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত যে সুবিধা পেতাম সেটা এখন কি হবে? এ প্রশ্নই নতুন করে দেখা দিয়েছে। তিনি মনে করেন, ব্যবসার দিক থেকে আমাদের দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও একইভাবে জিএসপিভুক্ত দেশগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এ কারণেই নতুন করে সমঝোতার বিষয়টি সামনে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্ডারে আমরা ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছি। এটাও এখন নতুনভাবে সমঝোতা করতে হবে। তার মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকাকালীন যে সুবিধা বাংলাদেশ পেয়েছে ব্রিটেন বেরিয়ে যাওয়ার পর স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে কতখানি সুবিধা বহাল থাকবে সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, পোশাক খাতে বড় ক্ষতি হবে না। তবে টানাপোড়েন লেগে থাকবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অভিবাসন। এতে কর্মসংস্থান কমে যাবে। রেমিটেন্সে প্রভাব পড়বে। দ্রুত কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষক মামুন রশীদ যুগান্তরকে বলেন, তৈরি পোশাকসহ অনেক পণ্য শুল্কমুক্তভাবে রফতানি করা যেত এতদিন। এখন সেসব ঢেলে সাজাতে হবে।
পোশাক খাতের রফতানি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যুগান্তরকে বলেন, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির পর যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি রফতানি হতো। এ অঞ্চলে রফতানির পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষতির আশংকা রয়েছে তা নিরূপণ করা হয়নি। পরে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে এ সমস্যা থেকে উত্তরণে কী ধরনের নীতি সহায়তা দিতে হবে তা জানানো হবে।
বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি আসলাম সানি বলেন, বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে রিফর্মের কারণে পোশাকের ক্রেতা কমে গেছে। নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে ইউরোপের বাজারে পোশাক রফতানি ২ থেকে ৩ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এছাড়া আরও বহুবিধ সমস্যা দেখা দেবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ব্র্যান্ডগুলো ভবিষ্যতে ব্রিটেনে কর সুবিধা পাবে কিনা এবং উল্টোভাবে ব্রিটেনের ব্র্যান্ডগুলো ইইউতে কী সুবিধা পাবে, তার ওপর পোশাকের মার্কেট শেয়ার নির্ভর করছে। এছাড়া এ সিদ্ধান্তের কারণে নেদারল্যান্ডস, স্পেনসহ অন্যান্য দেশ ইইউ জোটে থাকা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ইইউতে পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতার আশংকা রয়েছে।
রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক খাত তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যাবে। ব্রিটেন ইইউ থেকে আলাদা হওয়ার খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড এবং ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন ঘটেছে যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ৭ শতাংশ। গত ৩০ বছরে এ ধরনের দরপতন হয়নি। ফলে ব্রিটেনে ইইউর বিনিয়োগ কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। এতে ব্রিটেনের জনগণের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে দেশটির পোশাক আমদানিতে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির পর যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা হওয়ায় রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে মুদ্রার দরপতন হওয়ায় বাংলাদেশী রফতানিকারকদের সক্ষমতা কমে যাবে। বিটিএমইর সহ-সভাপতি ফজলুল হক বলেন, রফতানিতে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা এ মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না। তবে যেহেতু আলাদা হওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ৭ শতাংশ মুদ্রা অবমূল্যায়ন হয়েছে- তাই বলা যায় পোশাক রফতানিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে সরকারকে পোশাক রফতানির নীতি-সহায়তাগুলো নিয়ে পুনরায় ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ টেরি টাওয়াল অ্যান্ড লিনেন মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সাবেক সভাপতি খন্দকার আবদুল মোক্তাদির বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। অক্টোবরের পরে সমঝোতার ভিত্তিতে ব্রিটেন ইইউ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তবে ধারণা করা যায়, যেহেতু ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম ৭ শতাংশ কমে গেছে তাই পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেবে।