গুলশান হামলার পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ‘পোশাক শিল্পে’র ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত হয়ে উঠছেন দেশের গার্মেন্ট মালিকরা। শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কূটনৈতিকপাড়ার হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে বন্দুকধারীরা হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে জিম্মি করে। জিম্মিদশা কমান্ডোদের অভিযানে অবসানের আগেই ২০ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তারা। জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। বার্তাসংস্থা এএফপিকে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, ‘এ হামলার দরুন বিদেশীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ শিল্পের জন্য এ হামলার প্রভাব হবে খুবই ক্ষতিকর। আমরা এখন দারুণভাবে উদ্বিগ্ন।’ ফারুক হাসানের নিজের প্রতিষ্ঠান জায়ান্ট গ্রুপ ব্রিটেনের মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার ও নেক্সটসহ বহু রিটেইলারের জন্য পোশাক উৎপাদন করে।
সবশেষ এ হামলার আগে থেকেই বিভিন্ন জঙ্গি-সংক্রান্ত হামলায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক বাংলাদেশ আশংকায় ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভোগা দেশটি আরও গভীর বিশৃংখলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ বাড়ছে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের কো-ডিরেক্টর সারা লাবোয়িটজ বলেন, ‘ঢাকার জিম্মি সংকট মর্মস্পর্শী বিয়োগান্তক ঘটনা। দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তার প্রতিফলন এটি।’ লাবোয়িটজ আরও বলেন, বর্তমান সহিংসতার দরুন বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে। তার ভাষ্য, ‘সামনের মাসগুলো শপিং মৌসুম। আর এ ধরনের হামলার দরুন ক্রেতারা নিশ্চিতভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবে।’
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তবুও দেশটি প্রতিবছর ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখছে। এর অন্যতম কারণ গার্মেন্ট পণ্য রফতানি, যেটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। গত বছর মোট রফতানির ৮০ শতাংশই ছিল এ খাতের অবদান। পাশাপাশি এ খাতের হাজার হাজার কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ। এদের বেশিরভাগই দরিদ্র নারী। সুইডেনভিত্তিক বিশ্বখ্যাত পোশাক কোম্পানি এইচ অ্যান্ড এম বলেছে, এ বিয়োগান্তক হামলায় তারা গভীরভাবে ব্যথিত। এ কোম্পানির অনেক পোশাক উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র বোগ লিন্ড বলেন, ‘আমরা অবশ্যই ঢাকার পরিস্থিতির দিকে তীক্ষè নজর রাখছি।’
ইসলামাবাদে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রতিনিধি আহসান মনসুরের আশংকা, বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশকে হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। ঢাকার পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মনসুর বলেন, ‘আমি পাকিস্তানকে একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতি থেকে সন্ত্রাসের চারণক্ষেত্রে পরিণত হতে দেখেছি। এ হামলা আমাকে সেসব দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবুও আমি আশা করব পরিস্থিতি এমন মোড় নেবে না।’
তিনি বলেন, পাকিস্তানে যখন চরমপন্থী সহিংসতা ছড়াতে শুরু করল, আর্থিক নিুগামিতার প্রথম লক্ষণ দেখা গেল। অভিবাসী পরিবারগুলো তাদের ব্যাগ গুছিয়ে দেশের পথে পা বাড়াল। এরপরই বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংকুচিত হয়ে গেল। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হটস্পট, এমন ধারণা দেশের রফতানি সম্ভাবনা ও প্রবৃদ্ধিকে নিদারুণভাবে আঘাত করতে পারে।’ তবে বাংলাদেশ বহু ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়ে এখানে এসেছে। শ্রমিক অসন্তোষ, গণপরিবহন অবরোধ, ব্যাপক আকারে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কারখানা বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে আছে গার্মেন্ট শিল্প। এ বছরের জুনে বরং ১০ শতাংশ বেড়েছে পোশাক রফতানি।
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, বিদেশী রিটেইলাররা বাংলাদেশের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখবে। কিন্তু এ শিল্পের অনেক বিশেষজ্ঞের যুক্তি, শুধু বাংলাদেশই নয়; সস্তা শ্রমিক পাওয়া যায়, এমন অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট অস্থিরতা দানা বেঁধেছে। গত বছর থেকে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা প্রমাণ করে, শুধু উন্নয়নশীল দেশেই সীমাবদ্ধ নেই চরমপন্থী সহিংসতার ঝুঁকি। নয়াদিল্লিভিত্তিক রিটেইল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থার্ড আইসাইটের প্রধান নির্বাহী দেবাংশু দত্ত তাদেরই একজন। তিনি বলেন, ‘যদি ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করেন বিদেশীরা, সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। বিপুল পরিমাণ দারিদ্র্য উপদ্রুত জনসংখ্যার উন্নতির জন্য রফতানি ও বিদেশী বিনিয়োগ খুবই প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশীদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবারই জড়িত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।’