উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কঠিন শর্তের বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে সরকার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রাক্কলন হলো, চলতি অর্থবছরে এ ধরনের ঋণ অনুমোদন হতে পারে ৫০০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হারে যা দাঁড়াবে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকায়। মূলত এসব ঋণ চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং নতুন উন্নয়ন সহযোগী এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে এ ঋণ নেওয়া হবে। জানা গেছে, চীন ৪৪১ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ৩৯ কোটি ডলার এবং এআইআইবির কাছ থেকে সাড়ে ১৬ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে। এসব ঋণের সুদের হার দেড় শতাংশের কাছাকাছি হলেও কমিটমেন্ট ফি, ম্যানেজমেন্ট ফি এবং অন্যান্য ফি মিলে ঋণের বিপরীতে প্রায় পাঁচ শতাংশ চার্জ পরিশোধ করতে হবে। আবার ঋণ পরিশোধের সময়ও জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এবং বিশ্বব্যাংকের তুলনায় অর্ধেক। গ্রেস পিরিয়ডও তুলনামূলকভাবে খুব কম। ঋণের বড় অংশের অর্থ দিয়ে ঋণদাতা সংস্থার মনোনীত প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার শর্তও রয়েছে। ফলে এসব বিবেচনায় চীনের ঋণ হবে কঠিন শর্তের।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) নামের ওই ঋণ ১৯টি শর্ত মেনে নিয়েছিল বাংলাদেশ। যার মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল যে কোনো দাতা দেশ বা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশের বেশি ‘গ্রান্ট এলিমেন্ট’ থাকতে হবে। সুদের হার, রেয়াত কাল ও পরিশোধের মেয়াদ যত নমনীয় হয় তার গ্রান্ট এলিমেন্ট তত বেশি হয়। বিশ্বব্যাংক, জাইকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ৩৫ শতাংশের বেশি গ্রান্ট এলিমেন্ট থাকে। আলোচ্য ৫০০ কোটি ডলার ঋণের গ্রান্ট এলিমেন্ট ৩০ শতাংশেরও কম। এর রেয়াত কাল চার থেকে পাঁচ বছর। আবার ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করার শর্ত দিয়েছে সংস্থাগুলো। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, সব প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ও জাইকার মতো নমনীয় শর্তে ঋণ পাওয়া যায় না। যেহেতু উন্নয়ন চাহিদা বাড়ছে সেহেতু কিছু ঋণ কঠিন শর্তে নিতে হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, চীনের বড় অঙ্কের ঋণের নেপথ্যে রয়েছে সরকারি কর্তাদের কমিশন-বাণিজ্য। এ ঋণের আওতায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর খুব বেশি প্রয়োজন নেই। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হচ্ছে। একদিকে কঠিন শর্তের ঋণ নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ঋণের বিপরীতে নিম্নমানের পণ্য দেশে আসছে। এ ধরনের ঋণ অতিপ্রয়োজনীয় হলে উৎপাদনশীল খাতে নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু যেসব প্রকল্পে ঋণ নেওয়া হচ্ছে তা আগামী দিনে দেশের অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় হওয়ার পেছনে এ ধরনের ঋণ কাজ করছে।
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ১৭৫ কোটি ডলারের মধ্যে ১৩৯ কোটি ৩৯ লাখ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেছে চীন। জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত দ্বৈত রেললাইন স্থাপন প্রকল্পে ৭৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মিটার গেজ রেল লাইনের পাশাপাশি সমান্তরাল আরেকটি ব্রডগেজ লাইনে উন্নীতকরণে ২৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার ঋণ প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়াও সরকারি পাটকল আধুনিকায়নে ২৮ কোটি ডলার, পিজিসিবির পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণে ১৩২ কোটি ডলার এবং টেলিকমিউনিকেশনস লাইন আধুনিকায়নে ২০ কোটি ডলার সরকারি ঋণ প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। যে তিনটি প্রকল্পে অর্থায়ন করতে যাচ্ছে এআইআইবি সেগুলো হলো_ বসুন্ধরা অ্যান্ড উত্তরায় ডেসকোর ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাবস্টেশন নির্মাণ। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন এ দাতাসংস্থা ঋণ দেবে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা। রাজধানীতে ভূগর্ভস্থ ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে এআইআইবি প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। রেল মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিমানবন্দর থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত লাগেজ ভ্যান শীর্ষক একটি প্রকল্প রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ঋণ পাওয়া যাবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকে টেলিযোগাযোগ খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে ঋণ নেবে সরকার।
সাবেক সচিব ও ইআরডির বিশ্বব্যাংক উইংয়ের সাবেক প্রধান আরাস্তু খান সমকালকে বলেন, প্রায় পাঁচ বছর আগে সরকার বিদেশি ঋণ নেওয়ার নীতির ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এনেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি পেতে সহজ শর্তের পাশাপাশি সমানতালে চড়া সুদের ঋণও নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে চীন এবং রাশিয়া থেকে এ ধরনের ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ইআরডির এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে এবং সে লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে। এটি করতে হলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার তা শুধু সহজ শর্তের ঋণের ওপর নির্ভর করলে হবে না। মধ্য আয়ের অর্থনীতির লক্ষ্য পূরণ করতেই বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কঠিন শর্তে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয়।