বৈশ্বিক অর্থনীতির ঘাড়ে মন্দার খাড়া ঝুলছে। এ অবস্থায় আগামী ৪ সেপ্টেম্বর চীনের হ্যাংঝৌ শহরে শুরু হচ্ছে গ্রুপ অব টোয়েন্টির (জি২০) দুদিনের শীর্ষ সম্মেলন। বিশ্ব অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে আয়োজিত এ ফোরামে এবার মূল আলোচনা বিচ্যুত হতে পারে বেশকিছু রাজনৈতিক ইস্যুতে। খবর ব্লুমবার্গ। গত বছরের জি২০ আলোচনায় ছায়া ফেলেছিল প্যারিসে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা। এ কারণে তুরস্কের ওই সম্মেলনে মূল এজেন্ডার পাশাপাশি নেতারা ব্যস্ত ছিলেন সিরিয়া ইস্যুতে বেশকিছু দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে।
২০১৪ সালে জি২০ সম্মেলনে অর্থনৈতিক আলোচনাকে আড়াল করেছিল ক্রাইমিয়া ইস্যু। রুশ ফেডারেশনে ক্রাইমিয়ার অন্তর্ভুক্তি ও ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন জি২০ সম্মেলনে উত্তেজনা যোগ করেছিল। স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে মোকাবেলা করার (অ্যাবটের ভাষায় ‘শার্টফ্রন্ট’) হুমকি দিয়েছিলেন। রুশ নেতা সেবার আগেভাগেই জি২০ সম্মেলন ছেড়ে যান।
এবারের জি২০ সম্মেলন কিছু কারণে বিশেষ গুরুত্ববহ। বৈশ্বিক আর্থিক খাতে বহাল রয়েছে সর্বকালের নিম্নতম সুদহার। তার পরও অর্থনীতিকে টেনে তোলা যাচ্ছে না। ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার সিদ্ধান্ত বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২টি দেশের ট্রান্স-প্যাসিফিক চুক্তির (টিপিপি) ভাগ্য আপাতত অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। টিপিপি চুক্তির উদ্যোক্তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এটাই শেষ জি২০ অংশগ্রহণ।
এবারের জি২০ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো যোগ দিচ্ছেন সৌদি সিংহাসনের অন্যতম সম্ভাব্য উত্তরসূরি ডেপুটি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তুরস্কে গত বছরের সম্মেলনে সৌদি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। এবার তার ৩১ বছর বয়সী পুত্র সৌদি আরবের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম অর্থনীতিকে তেলনির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনতে মোহাম্মদ বিন সালমান ভিশন ২০৩০ নামের রূপকল্প প্রণয়ন করেছেন। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য সংযোজনে তার পরিকল্পনায় আগামী পাঁচ বছরে ২৭০ বিলিয়ন রিয়াল (৭ হাজার ২০০ কোটি ডলার) ব্যয়ের কথা রয়েছে। জি২০ সম্মেলনে মোহাম্মদ বিন সালমান এ সংস্কার পরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন বলে সৌদি কর্মকর্তাদের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই তার দেশের বিনিয়োগ নীতিমালাকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে শীতলতা নেমে আসে। চীনে জাস্টিন ট্রুডোর এটা প্রথম সরকারি সফর। কানাডার তরুণ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সঙ্গে তার সম্পর্ক কীভাবে পুনর্গঠন করেন, সেটা দেখার বিষয়। পূর্ব এশিয়ার অগ্রসর অর্থনীতি সিঙ্গাপুর জি২০ ফোরামের সদস্য নয়। তবে হ্যাংঝৌয়ে আমন্ত্রিত অতিথি তালিকায় সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংয়ের নাম রয়েছে। টিপিপির অন্যতম প্রবক্তা লি সিয়েন লুং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কেমন ভারসাম্য রাখেন, পর্যবেক্ষকদের অনেকে সেদিকে দৃষ্টি দেবেন।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জিলমা হুসেফের অভিসংশন শুনানি চলছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল তেমার বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। জি২০ সম্মেলনে তিনি ব্রাজিলের প্রতিনিধিত্ব করতে আশাবাদী। হ্যাংঝৌয়ে অনেকের নজরে থাকবেন উচ্চাভিলাষী এ রাজনীতিক। অর্থনৈতিক আলোচনা ছাপিয়ে এবারের জি২০ সম্মেলনে প্রভাব বিস্তার করবে কিছু আনুষঙ্গিক ইস্যু।
হিঙ্কলে পয়েন্ট পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের অনুমোদন পিছিয়ে দেয়ায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্কে মৃদু উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। গত অক্টোবরে এ বিদ্যুেকন্দ্রে ৬০০ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং লন্ডন-বেইজিং সম্পর্ককে ‘স্বর্ণ যুগ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মে চীনের এ বিনিয়োগ প্রকল্পের অনুমোদন নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে পিছিয়ে দিয়েছেন। চীন বলেছে, হিঙ্কলে পয়েন্ট প্রকল্প ইস্যুটি দুই দেশের সম্পর্ককে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী মে এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংকে চিঠি লিখেছেন। হ্যাংঝৌয়ে চীনা নেতারা নিশ্চয় তার কাছে আরো বেশি কিছু শুনতে চাইবেন। উত্তর এশিয়ার শক্তিশালী তিন অর্থনীতি চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ত্রিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তির পথে বহু দূর অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এসব দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে অবিশ্বাস যোগ হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের টার্মিনাল হাই অলটিচিউড এরিয়া ডিফেন্স সিস্টেম (থাড) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন কেন্দ্র করে চীন আপত্তি জানিয়েছে। অতীতে কোরীয় প্রেসিডেন্ট পাক গুন হেকে স্বাদর অভ্যর্থনা জানালেও এবার সম্ভবত প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হবেন না।
পূর্ব চীন সাগরে সেনকাকু অথবা দিয়াও দ্বীপ কেন্দ্র করে ভূখণ্ডগত বিরোধ চলছে বেইজিং ও টোকিওর মধ্যে। আবার অসগ্রিডে দুটি চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ ঠেকিয়ে দেয়ায় চীন অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক সম্পর্কেও মেঘের ছায়া দেখা যাচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির ওয়েবসাইট হ্যাকের ঘটনাকে ঘিরে মস্কোর সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে বাড়তি উত্তেজনা যোগ হয়েছে। এবারের জি২০ সম্মেলনে অর্থনৈতিক এজেন্ডাকে ছাপিয়ে যাবে এসব আনুষঙ্গিক ইস্যু।