Home বাংলা নিউজ ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ আটকা পড়েছে অর্থতন্ত্রে: আইনসভা

ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ আটকা পড়েছে অর্থতন্ত্রে: আইনসভা

ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ আটকা পড়েছে অর্থতন্ত্রে: আইনসভা

পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের আধিপত্য খর্ব করতে ১৯৫৩ সালের গোড়ার দিকে শুরু হয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের আলোচনা। এ ফ্রন্টের প্রধান স্তম্ভ ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ)। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে শক্তিমত্তার জানান দেয় এ ফ্রন্ট। ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে জয় পায় ২২৮টিতে। নির্বাচনের পর আড়াইশ সদস্যবিশিষ্ট যে আইনসভা গঠন হয়, তাতে অর্ধেকের বেশি সদস্যই ছিলেন আইনজীবী। ব্যবসায়ী ছিলেন ৫ শতাংশেরও কম।

১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের শরিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে জয়লাভ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ নিয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসাবে দিয়েছিল নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।’

ওই সময় থেকেই সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতার কেন্দ্রে এখনো আওয়ামী লীগই। কিন্তু বদলে গেছে দলের আইনপ্রণেতাদের ধরন। একসময় আইনজীবীদের প্রাধান্য থাকলেও সে জায়গায় এখন ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সংসদে ব্যবসায়ী রয়েছেন ৫০ শতাংশ। একক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ব্যবসায়ী ৫৬ শতাংশ। আর আইনজীবী প্রায় ১৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সারা বিশ্বেই আইনসভায় আইনজীবীদের প্রাধান্য থাকে। উপমহাদেশের রাজনীতিতেও একই চিত্র ছিল। তবে এখন তা অনেক কমে গেছে। এতে গুণগত কী পরিবর্তন হয়েছে, তার মূল্যায়ন করবে জনগণ। ১৯৫৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আইনসভার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের আইনসভার সদস্য ছিলেন ২৫০ জন। এর মধ্যে ১১৬ জন অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ সদস্যই ছিলেন আইনজীবী। যুক্তফ্রন্টের নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নিজেও ছিলেন আইনজীবী।

এর পর ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে আইনসভায় আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্ব। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আইনসভায় আইনজীবী কমে দাঁড়ায় ২৯ শতাংশে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তা আরো কমে হয় ২৬ শতাংশ। এছাড়া ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সংসদে আইনজীবীর হার কমে দাঁড়ায় ২৩, ১৯৯১ সালে ১৯, ১৯৯৬ সালে ১৫ ও ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদে মাত্র ১২ শতাশ। এর পর ২০০৮ সালের নবম সংসদে আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্ব কিছুটা বেড়ে ১৪ দশমিক ৭২ হলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদে তা আবার ১৪ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে। এ সংসদে ৩৫০ আইনপ্রণেতার মধ্যে আইনজীবী রয়েছেন মাত্র ৫১ জন।

আইনসভায় আইনজীবীর সংখ্যা কমার বিপরীতে বাড়ছে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত আইনসভায় ৪ শতাংশ ব্যবসায়ী থাকলেও ২০১৪ সালে দশম সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। এছাড়া ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর গঠিত আইনসভায় ব্যবসায়ী ছিলেন ২৭, ১৯৭৩ সালে ২৪, ১৯৭৯ সালে ২৮, ১৯৯১ সালে ৫৩, ১৯৯৬ সালে ৪৮, ২০০১ সালে ৫৮ ও ২০০৮ সালে ৫৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদে ব্যবসায়ী রয়েছেন মোট আইনপ্রণেতার ৫০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসায়িক সুযোগ নিতে ব্যবসায়ীদের অনেকে রাজনীতিতে আসছেন। বিপুল অর্থ ব্যয় করে তারা দলীয় মনোয়ন পেয়ে নির্বাচন করছেন। নির্বাচনে জিতে আইনসভার সদস্যও হচ্ছেন তারা। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব অনেক বেড়েছে। এক্ষেত্রে আইনজীবীরা দুর্বল। ফলে তারা মনোনয়ন পাচ্ছেন কম, নির্বাচিতও হচ্ছেন কম। যাদের অর্থ আছে, অন্য সব ক্ষেত্রের মতো রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করে আছেন তারাই। ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য তারা আইনসভার সদস্যও হচ্ছেন।

সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মধ্যেও ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য। বর্তমানে দলটিতে আইনজীবী সংসদ সদস্য মাত্র ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর ব্যবসায়ী ৫৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। যদিও একসময় দলের আইনপ্রণেতার অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী। দলের অন্যতম স্তম্ভ জাতীয় চার নেতার তিনজনই ছিলেন আইনজীবী। ময়মনসিংহ জেলা বারের আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ১৯৫১ সালে আইন পেশা শুরু করেন পাবনা জেলা আদালতে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাবনা-১ আসন থেকে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৪ সালে কারাবন্দি অবস্থায় আইন পাস করেন তাজউদ্দীন আহমদ।

আইনজীবী নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচন এখন  ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। আইনজীবীদের মনোনয়ন দিলে তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থ খরচ করতে পারেন না। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোও আইনজীবীদের মনোনয়ন দিতে কার্পণ্য করে। অর্থ খরচের বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যবসায়ীকেই মনোনয়ন দেয় বড় দলগুলো। এজন্য বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐকমত্য প্রয়োজন। আইনসভায় সব পেশার লোকই থাকতে হবে। তবে আইনজীবীদের সংখ্যা যত বেশি হয় তত ভালো। তাতে সঠিক আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে। কারণ আইনসভায় আইনজীবীরাই যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এলাকার মানুষ আর্থিক সহায়তা পাওয়ায় তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা সমর্থন থাকে বলে মনে করেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। তিনি বলেন, কর্মীদের মনোভাব থাকে ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেয়ার পক্ষে। এজন্য মনোনয়ন পেলে তারা নির্বাচিত হন। ব্যবসায়ীর সংখ্যা অত্যধিক হওয়াও আবার ভালো নয়। অন্যদিকে আইনজীবীও যদি একদমই কম থাকেন, সেক্ষেত্রও সমস্যা হবে। প্রকৃত রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, ব্যবসায়ীসহ সংসদে সব পেশার প্রতিনিধিত্ব থাকলে ভারসাম্য রক্ষা হবে।

আইনজীবীদের সংখ্যা কমে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রভাব পড়ছে দুর্বল আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সংসদে এমপিদের আচরণবহির্ভূত কার্যকলাপে। সম্প্রতি আদালত অবমাননা আইন ও বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে জাতীয় সংসদে পাস করা বিল বাতিল করে দেন উচ্চ আদালত। বাতিল হয়েছে সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনীও। সংসদ সদস্যদের অজ্ঞতার বিষয়টি তুলে ধরে সঠিকভাবে আইন প্রণয়নের তাগিদ দেন প্রধান বিচারপতি।