আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানা। ১৯ আগস্ট সকাল ১০টা বাজতেই কারখানায় গ্যাসের চাপ কমে গেল। বয়লার আর চলে না। কী আর করা, সাপলুডু খেলে সময় কাটাতে থাকেন শ্রমিকরা। দিনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টার মধ্যে তিন থেকে চার ঘণ্টা এভাবেই পার হয় তাদের। অথচ সময়মতো পণ্য সরবরাহ করার জন্য মাথার ওপর বিদেশি ক্রেতার বেঁধে দেওয়া সময়ের খৰ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য উৎপাদন করতেই হবে।
এ রকম পরিস্থিতিতে পার্শ্ববর্তী সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারভর্তি গ্যাস দিয়ে কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন ওই কারখানার কর্মকর্তারা। সিলিন্ডারে করে এই গ্যাস পরিবহনে ঝুঁকি রয়েছে। সিএনজি স্টেশনের এই গ্যাস দিয়ে শিল্পকারখানা চালানো একপ্রকার অবৈধ। তবুও উপায়হীন হয়ে কারখানার কর্মকর্তারা সিএনজি দিয়েই কারখানা চালু রাখছেন। সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশে এখন প্রায় ২০০ পোশাক কারখানা বিকল্প এ উৎস থেকে গ্যাস নিয়ে কোনো রকমে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।
সিএনজি স্টেশনের গ্যাসে উৎপাদন চলছে_ এ রকম বেশ কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংযোগ স্থানান্তর, নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেও কোনো ফল হয়নি। এ কারণে বাধ্য হয়েই ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিয়েছেন তারা। সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস নিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এভাবে গ্যাস নিতেও ঝামেলা অনেক। পুলিশ এবং সিএনজি স্টেশন কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। স্টেশন কর্তৃপক্ষ গ্যাস দিতে রাজি হয় না। কারণ এতে ফিলিং স্টেশনে গ্যাসের চাপ কমে যায়। এ ছাড়া নিয়ম না থাকায় অবৈধভাবে গ্যাস সরবরাহ করলে সিএনজি স্টেশনের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে সতর্ক করেছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। আবার কাভার্ডভ্যানে কারখানায় গ্যাস নেওয়ার সময় রাস্তায় ‘পুলিশি ঝামেলা’ থাকে। সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করেই সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস নিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। একাধিক উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, গ্যাস
পাইপলাইনে চাপ কম থাকায় অনেক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রফতানি আদেশ অনুযায়ী সময়মতো ক্রেতাদের হাতে পোশাক পৌঁছানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। কখনও কখনও ১৫ গুণ বেশি ব্যয়ে আকাশপথে ক্রেতাদের হাতে পোশাক পৌঁছে দিতে হয়। বহুক্ষেত্রে রফতানি আদেশ বাতিল করেন ক্রেতারা। স্টকলট (উৎপাদিত পণ্য নিতে ক্রেতাদের অনীহা) কিংবা ডিসকাউন্ট (চুক্তির তুলনায় দর কম দেওয়া) দিয়ে তখন আর্থিক লোকসানে পড়েন ছোট-মাঝারি মানের কারখানা মালিকরা। অনেকের পথে বসার উপক্রম হয়। আবার কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরও শুধু গ্যাস সংযোগের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না অনেক নতুন কারখানা। এ কারণে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই বিকল্প পথ হিসেবে সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। ঝুঁকিপূর্ণ এ পথে ব্যয় বাড়লেও অন্তত উৎপাদন কার্যক্রম কোনো রকমে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মইনুদ্দিন সমকালকে জানান, দুই বছর আগে গ্যাসের জন্য আবেদন করেও কোনো সাড়া পাননি। কারখানা চালু রাখতে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডারে ভরে পিকআপভ্যানে তুলে কারখানায় গ্যাস নিয়ে আসা হয়। এতে স্বাভাবিকের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। তারপরও ক্রেতাদের সময়মতো পোশাক সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন সাভারের একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ।
গ্যাস সংযোগ এবং লোডবৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে না পারলেও সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের একটা বিহিত করেছিল বিজিএমইএ। সদস্যদের জন্য বিজিএমইএ সিলিন্ডারবাহী গাড়ি চলাচলে সনদের ব্যবস্থা করেছিল। তবে এই প্রক্রিয়াও এখন বন্ধ।
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে বিকল্প উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহের অনুমোদন দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। জ্বালানি সচিব নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর পরামর্শে গত জুনে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (ইআরসি) আবেদন করা হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি বিজিএমইএর কাছে পাঠানো এক পত্রে ইআরসি জানিয়েছে, অবৈধ এ প্রক্রিয়ার গ্যাস ব্যবহারে অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিএমইএর এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কারখানায় গ্যাস সংকটের বিষয়ে ইআরসি ভালোভাবে অবহিত। এ কারণে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিএনজি স্টেশনের গ্যাস কারখানায় নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি অবৈধ হলেও এতে ‘না দেখার ভান’ করতে রাজি আছে ইআরসি। মৌখিকভাবে বিজিএমইএকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু সমকালকে বলেন, যেসব কারখানা আবেদন করেও গ্যাস পায়নি সেসব কারখানা স্থানীয় সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে কোনো রকমে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের সংকটে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস পরিবহনের মাধ্যমে উৎপাদন চালাচ্ছে এ রকম কারখানার সংখ্যা অন্তত ২০০।