শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা মার্জিনে মিশ্র চিত্র দেখা যাচ্ছে। পোশাক বিক্রিতে শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোই বিক্রির বিপরীতে নিট মুনাফায় অনেক পিছিয়ে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে রফতানিতে শীর্ষে থাকলেও অস্বাভাবিক উত্পাদন খরচের কারণে নিট মুনাফায় সবচেয়ে পিছিয়ে এপেক্স স্পিনিং অ্যান্ড নিটিং মিলস ও স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড। এদিকে একই খাতে বিক্রির বিপরীতে সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ পর্যন্ত নিট মুনাফা করছে অন্যান্য তালিকাভুক্ত কোম্পানি। দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ১১টি পোশাক কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে বিক্রির বিপরীতে এপেক্স স্পিনিংয়ের নিট মুনাফা মাত্র শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ। চলতি প্রথম প্রান্তিকে তা আরো কমে শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়া ৩১ মার্চ পর্যন্ত এক বছরে রফতানির বিপরীতে স্টাইল ক্রাফটের নিট মুনাফার হার ১ দশমিক ১ শতাংশ। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পণ্য রফতানির বিপরীতে সরকারি নগদ সহায়তা না পেলে লোকসানে পড়ত কোম্পানি দুটি।
ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ফ্যামিলিটেক্স, জেনারেশন নেক্সট, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িংয়ের মতো কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে। সর্বশেষ হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে ফ্যামিলিটেক্সের নিট মুনাফার মার্জিন ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ, জেনারেশন নেক্সটের ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
তালিকাভুক্ত একই খাতের কোম্পানির নিট মুনাফায় এত বড় ব্যবধান অস্বাভাবিক বলে মনে করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বণিক বার্তাকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছেন কমিশনের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান।
নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য নিট পণ্য উত্পাদন করে এপেক্স স্পিনিং। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত (হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিক) ২৫৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকার পণ্য রফতানি করে কোম্পানিটি। বিক্রীত পণ্যের উত্পাদন খরচ (কস্ট অব গুডস সোল্ড) হয় ২৩৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা মোট বিক্রির ৯২ শতাংশের বেশি। এ সময়ে প্রশাসনিক ও বিক্রি বাবদ অন্যান্য ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সুদ ও কর বাবদ ব্যয়ের পর কোম্পানিটির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, যা এ সময়ে মোট বিক্রির শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ।
তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলো রফতানির বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা পেয়ে থাকে। সর্বশেষ হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে এপেক্স স্পিনিং রফতানির বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা নগদ সহায়তা পেয়েছে। নগদ সহায়তা হিসেবে স্টাইল ক্রাফট ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ সময় পর্যন্ত এক বছরে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা পেয়েছে।
তালিকাভুক্ত তৈরি পোশাক কোম্পানিগুলোর মধ্যে রফতানি আয় সবচেয়ে বেশি স্টাইল ক্রাফটের। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বছর সমাপ্তির সময় ছিল মার্চ। তবে সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে চলতি বছর উত্পাদনমুখী কোম্পানিগুলোর হিসাব বছর সমাপ্তির সময় নির্ধারণ করা হয় জুন। ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ সময় পর্যন্ত এক বছরে স্টাইল ক্রাফট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩ লাখ ৩ হাজার ৪৬৫ ডজন শার্ট রফতানি করে, যার মূল্য দাঁড়ায় ৩৫৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এ সময় সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তা পায় ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কোম্পানিটি নগদ সহায়তার অর্থ টার্নওভারে যোগ করেছে। সব মিলিয়ে কোম্পানির টার্নওভার দাঁড়ায় ৩৬৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ সময় উত্পাদন খরচ ছিল ৩৪২ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা মোট বিক্রির ৯৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। নগদ সহায়তার অর্থ বাদ দিলে উত্পাদন খরচ দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ৮৮ শতাংশে। প্রশাসনিক, বিক্রি ও সুদ বাবদ ব্যয় ও অন্যান্য খরচ বাদ দেয়ার পর কোম্পানির নিট মুনাফা দাঁড়ায় ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। রফতানি আয়ের বিপরীতে নিট মুনাফার অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ১ শতাংশ।
স্টাইল ক্রাফটের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫৫ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা কম থাকায় আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৯৪ পয়সায়। আর ১৫ মাসে ইপিএস হয় ৯৫ টাকা ৪২ পয়সা। গতকাল এ কোম্পানির শেয়ারের সমাপনী দর ছিল ১ হাজার ৬৬৫ টাকা ৯০ পয়সা।
সর্বশেষ হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে রফতানি আয়ের বিপরীতে নিট পণ্য প্রস্তুতকারী ফারইস্ট নিটিংয়ের নিট মুনাফার মার্জিন ছিল ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকার রফতানি আয়ের বিপরীতে সে সময় কোম্পানিটির নিট মুনাফা ছিল ২৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। উত্পাদন খরচ ছিল মোট বিক্রির প্রায় ৭৫ শতাংশ। চলতি প্রথম প্রান্তিকে এ কোম্পানির নিট মুনাফার মার্জিন কিছুটা কমে ৯ দশমিক ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সর্বশেষ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত ফ্যামিলিটেক্সের রফতানি আয় ছিল ১৮৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ওই সময়ে নিট মুনাফা হয়েছে ৪০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এতে বিক্রির বিপরীতে নিট মুনাফার মার্জিন দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ। একই সময়ে জেনারেশেন নেক্সট ফ্যাশনের রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ২০৪ কোটি টাকা, যা থেকে নিট মুনাফা হয়েছে ৩৩ কোটি ৭ লাখ টাকা। নিট মুনাফার অনুপাত ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। অবশ্য চলতি প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির নিট মুনাফার মার্জিন ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। মিথুন নিটিংয়ের ৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা বিক্রির বিপরীতে নিট মুনাফার মার্জিন ছিল ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। চলতি প্রথম প্রান্তিকে তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের নিট মুনাফার মার্জিন ছিল ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ।