ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের কারণে নারায়ণগঞ্জকে এক সময় প্রাচ্যের ডান্ডি বলে ডাকা হতো। অতীতের সেই ঐতিহ্য হারিয়েছে আগেই। যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তাও হারিয়ে যেতে বসেছে ভারতীয় কাপড়ে বাজার সয়লাব হওয়ার কারণে। জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগ তাঁত বন্ধ। বেশকিছু বন্ধের পথে রয়েছে। যেগুলো কোনো রকমে টিকে আছে সেগুলোকে ভারতীয় কাপড়ের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গেও। উপজেলার তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপগঞ্জের তারাব পৌর এলাকার নোয়াপাড়ার জামদানি পল্লীতে এক সময় বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় বোনা হতো। এখান থেকে উত্পাদিত কাপড় দেশী-বিদেশী বণিকদের হাত ধরে বিক্রি হতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ঐতিহ্যবাহী মসলিন হারিয়ে গেলেও এর রেশ থেকে গেছে জামদানিতে। জামদানির ওপর ভর করে রূপগঞ্জের তাঁতিরা এখনো টিকে আছেন।
তবে কাঁচামালের বাড়তি দাম ও উত্পাদন খরচ বেশি হওয়ায় লাভ কমে গেছে। তাঁতিরা জানিয়েছেন, বর্তমানে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় কাপড়। দামে সস্তা আর ভালো ডিজাইন হওয়ায় তাঁতের বদলে এসব কাপড়ে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন ক্রেতারা। এ প্রসঙ্গে উপজেলার গাউছিয়া মার্কেটের তামিশ ফ্যাশনের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ক্রেতারা দোকানে এসেই ভারতীয় কাপড় দেখতে চান। কেউ কেউ চায়না কাপড়েরও ভক্ত। সে তুলনায় দেশী তাঁতের কাপড়ের চাহিদা নেই বললেই চলে। এ কারণে আমরা তাঁতের কাপড় খুব একটা রাখি না।’তারাব এলাকার তাঁত কারিগর শহিদুল্লা মিয়া বলেন, ‘একজন রিকশাচালক দিনে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারেন। সে তুলনায় তাঁতিদের দৈনিক আয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা উত্পাদিত বিভিন্ন কাপড় বাজারে পাইকারিভাবে সরবরাহ করি। কম দাম নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা সময়মতো এসব কাপড়ের দামটাও পাই না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা টালবাহানা করে কাপড়ের দাম পরিশোধ করেন দেরিতে।’ তাঁতে কাজ করে জীবন চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘সুতা, রঙসহ তাঁত শিল্পে ব্যবহূত বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁতিরা। এর পরও আমাদের তৈরি কাপড়ের বদলে অভিজাত দোকানগুলোয় সাজানো থাকে ভারতীয় কাপড়। ফলে আমরা বিভিন্ন হাট-বাজারে এসব কাপড় সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।’রূপগঞ্জের গাউছিয়া, তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়া জামদানি পল্লী, কাঞ্চন বাজার, মুড়াপাড়া বাজার, ইয়াপুরার হাটে সরেজমিন দেখা গেছে, তাঁতিদের নিলামে কাপড় বিক্রি করতে। এখান থেকে ব্যবসায়ীরা সস্তায় কাপড় কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন।
অন্যদিকে, স্থানীয় অভিজাত কাপড়ের দোকানগুলোয় দেখা গেছে উল্টো চিত্র। এসব দোকান ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কাপড় ও দেশী টেক্সটাইল ও গার্মেন্টে তৈরি কাপড়ে সয়লাব। দেশী তাঁতের কাপড়ের চাহিদা অনেক কম বলে এসব দোকানের ব্যবসায়ীরা জানান। রূপগঞ্জে রয়েছে দেড় শতাধিক টেক্সটাইল মিল। টি-শার্ট, থ্রি-পিস, শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় বানানো হয় এসব মিলে। উন্নত প্রযুক্তি আর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এসব মিলে উত্পাদন কার্যক্রম চলে। ভারতীয় কাপড়ের পাশাপাশি স্থানীয় তাঁতিদের এসব টেক্সটাইল মিলের সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় স্থানীয় তাঁতিদের উন্নয়নের জন্য সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কাঞ্চন পৌরসভা এলাকার রূপা টেক্সটাইল মিলের মালিক খলিল সিকদার বলেন, ‘তাঁত শিল্পের উন্নয়নে সরকার তেমনভাবে সহযোগিতা করছে না। পুঁজি আর প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁতিরা দিন দিন প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে পিছিয়ে পড়ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে মসলিনের মতো হয়তো তাঁত শিল্পও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’