চট্টগ্রামের কেইপিজেডে আয়োজিত আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্পে ছবি আঁকছেন শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামান। পাশে অভিনেতা ও চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলোচট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (কেইপিজেড) সবুজ মাঠের চারপাশে ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাড়। মাঠের একপাশে টানানো শামিয়ানার নিচে সারি সারি ইজেলে ঝুঁকে ক্যানভাসে তুলির টান দিচ্ছিলেন শিল্পীরা। তাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ঢোল বাজিয়ে চলেছেন শিল্পী বাবুল জলদাস ও তাঁর দল। এমন উৎসবমুখর পরিবেশে গতকাল সোমবার ছয়টি দেশের ১৯ জন শিল্পীকে নিয়ে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প।
এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা উৎসবের অংশ হিসেবে এই আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সহযোগিতায় রয়েছে ইয়াংওয়ান করপোরেশন। আর্ট ক্যাম্প উপলক্ষে দুপুর ১২টায় কেইপিজেডের ডরমিটরির পাশের খোলা মাঠে এসে জড়ো হন শিল্পীরা। এরপর একটি ক্যানভাসে সবাই মিলে তুলির আঁচড় বুলিয়ে, স্বাক্ষর দিয়ে উদ্বোধন করেন আর্ট ক্যাম্পের।
ক্যাম্পে অংশ নিয়েছেন ভারতের শিল্পী ধীরাজ চৌধুরী, চীনের থাং চ্রিং কাং, জাপানের টয়োমি হোশিনা, দক্ষিণ কোরিয়ার সং ডেসুপ, শ্রীলঙ্কার জগৎ রবীন্দ্রা, বাংলাদেশের সমরজিৎ রায়চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, কালিদাস কর্মকার, আবুল বারাক আলভী, ফরিদা জামান, নাইমা হক, নাজলী লায়লা মনসুর, মোহাম্মদ ইউনুস, রোকেয়া সুলতানা, আফজাল হোসেন, মুনিরুজ্জামান ও মোহাম্মদ ইকবাল।
আর্ট ক্যাম্পের সমন্বয়কারী ও ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মেহ্দী মাহবুব বলেন, এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা উৎসবে যোগ দেওয়া শিল্পীদের নিয়ে এই আয়োজন। সোমবার থেকে ক্যাম্প শুরু হলেও মঙ্গলবার (আজ) আর্ট ক্যাম্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান কিহাক সাং। তিন দিনের আর্ট ক্যাম্পে প্রত্যেক শিল্পী দুটি করে ছবি আঁকবেন। সেই সব ছবি প্রদর্শিত হবে ১৮তম এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা উৎসবে।
উৎসবে যোগ দেওয়া ভারতের শিল্পী ধীরাজ চৌধুরী কিছুদিন আগে ৮০ বছর পেরিয়েছেন। কিন্তু বয়সের বাধা তুচ্ছ করে ছুটে এসেছেন প্রিয় বাংলাদেশের টানে। ধীরাজ চৌধুরীর জন্ম বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ বিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বাইয়ে তিনটি প্রদর্শনী করেছেন। সেই অবদানের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। এই আয়োজনে এসে কেমন লাগছে জানতে চাইলে ধীরাজ চৌধুরী বলেন, ‘এ দেশের জন্য একাত্তরে প্রদর্শনী করেছি। এই চট্টগ্রামেই আমার পড়াশোনা। ভীষণ অন্য রকম লাগছে।’
ক্যাম্পের প্রথম এক ঘণ্টায় ছবি এঁকে শেষ করেছেন শিল্পী কালিদাস কর্মকার। তুলি ছাড়াই হাতে রং লাগিয়ে ছবি এঁকেছেন তিনি। তাঁর ইজেল ঘিরে ভিড়ের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা ও শিল্পী আফজাল হোসেনও। কী করে এত দ্রুত শেষ করলেন—আফজালের এমন প্রশ্নের উত্তরে কালিদাস বলেন, ‘আমার ছবির নাম “রঙের ঝড়”।’ তাঁর এই উক্তির পর আফজাল হোসেনের মন্তব্য, ‘আসলেই কালিদাস রঙের ঝড়ই যেন তৈরি করলেন।’
ক্যাম্পে একমনে ছবি আঁকতে দেখা যায় চীনের শিল্পী থাং চ্রিং কাংকে। বাংলাদেশের চিত্রকর্ম কেমন লেগেছে জানতে চাইলে বলেন, বাংলাদেশের শিল্পীরা দেশপ্রেমিক ও গণমুখী। অন্যদিকে চীনের বেশির ভাগ শিল্পী এখনো আঙ্গিকনির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের প্রখর সূর্যালোক আর সবুজ প্রকৃতি মুগ্ধ করেছে জাপানের শিল্পী টয়োমি হোশিনাকে। জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব আর্টসের ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি। সে দেশের প্রথম সারির শিল্পীও। আর্ট ক্যাম্প সম্পর্কে তিনি বলেন, উন্মুক্ত পরিসরে এমন আর্ট ক্যাম্প তাঁকে পরিবেশের কথা ভাবতে বাধ্য করছে। আরও অনেক দেশের শিল্পীদের নিয়ে নিয়মিত এ ধরনের আয়োজন হওয়া উচিত। এর পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে সেমিনারও হতে পারে। আয়োজন সম্পর্কে শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, বর্তমানে শিল্পের বিশ্বায়ন ঘটছে। ফলে প্রতিমুহূর্তে শিল্পী নিজেকে নবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ধরনের আয়োজন সেই কাজকে আরও সহজ করবে।