তানিয়া আক্তার ও লাকি আক্তার দুই বোন। শৈশবে বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাইয়ের আয়ে তাঁদের পরিবার চলত অভাব-অনটনে। দিন বদলাতে শুরু করে বছর তিনেক আগে, যখন কর্ণফুলী শু ফ্যাক্টরিতে কাজ জোটে।
এখন দুই বোন মিলে মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় করেন। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা একটি বেসরকারি ব্যাংকে সঞ্চয় করেন, বাকিটা সংসারে খরচ করেন। বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থায় এখন যে ৮ লাখ কোটি টাকার আমানত আছে, তাঁর মধ্যে দেড় লাখ টাকা কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (কেইপিজেড) পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুড়ুমছড়ার এই দুই তরুণীর।
তানিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, এই যে এখন তাঁরা আয় করছেন, তাতে সংসারে কী পরিবর্তন এসেছে। তিনি বললেন, তাঁদের ঘর বসবাসের উপযোগী করেছেন। আগের চেয়ে এখন খাওয়া-দাওয়া ভালো। সব মিলিয়ে বেশ সুখে আছে তাঁদের পরিবার।
তানিয়া ও লাকির মতো তাসলিমা, খুরশিদা, কাওসার আক্তারদের জীবনে পরিবর্তন এনেছে কেইপিজেড। তাঁরা এখন আয় করেন, সঞ্চয় করেন, নিজেদের পছন্দের জিনিস কিনতে পারেন। কর্ণফুলী শু ফ্যাক্টরিতে তাঁদের হাতে তৈরি পোশাক, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
কর্ণফুলী শু ফ্যাক্টরি কেইপিজেডের প্রথম কারখানা। সেখানে এখন প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক আশপাশের গ্রামের। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কারখানা তৈরি হলে কেইপিজেডে সরাসরি এক লাখের বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে বলে মনে করে কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৯ সালে ২ হাজার ৪৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার কোরিয়া সরকারের মনোনীত প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়। ইয়াংওয়ান প্রতিষ্ঠা করে কেইপিজেড করপোরেশন নামের একটি কোম্পানি। পরিবেশ অধিদপ্তর কেইপিজেডকে ছাড়পত্র দেয় ২০০৯ সালে।
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের শর্ত অনুযায়ী মোট জমির ৫২ শতাংশ বৃক্ষরোপণ, জলাধার সৃষ্টি ও উন্মুক্ত এলাকা হিসেবে রাখতে হবে। এ শর্ত মেনে ৮২২ একর জমিতে ২০ লাখ গাছ লাগানো হয়েছে। ৪৭০ একর জমিতে ১৭টি জলাধার সৃষ্টি করা হয়েছে এবং উন্মুক্ত এলাকায় ঘাস লাগিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনোদনের জন্য গলফ কোর্স তৈরি করা হয়েছে। বাকি থাকা ১ হাজার ২০০ একর জমিতে অবকাঠামো তৈরি করা যাবে। এ জমির ৩৩ শতাংশে রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রায় শেষ। ফলে কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জমি বাকি থাকে ৮৫৮ একর। এর মধ্যে ৫১৬ একর জমির উন্নয়নকাজ শেষ। বাকি ৩৪২ একর জমির উন্নয়নকাজ এগিয়ে চলছে। কেইপিজেড বলছে, এ উন্নয়নকাজ শেষ হতে দুটি শুকনো মৌসুম লাগবে।
কেইপিজেডে এখন সকালে ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচিরে। বিকেলেই শোনা যায় শেয়ালের ডাক। লেকগুলোয় অতিথি পাখিরা এসে ভরে গেছে। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই চলছে উৎপাদন কার্যক্রম। এটি পুরো পরিবেশবান্ধব রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ এ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ২২টি কারখানা ভবন নির্মাণ করেছে, যার আয়তন ২৫ লাখ বর্গফুট। ইয়াংওয়ান একটি পলিয়েস্টার কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে, ফলে মাস দুয়েকের মধ্যে আরও ৪ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট কারখানার জায়গা যোগ হবে। তিনটি ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের নির্মাণকাজ চলছে। বিনিয়োগকারীদের থাকার জন্য একটি গেস্টহাউস চার বছর আগেই নির্মাণ করা শেষ হয়েছে। আরও একটি নির্মাণের কাজ চলছে। ১৬ কিলোমিটার লাইন বসিয়ে পুরো এলাকায় বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। নারী শ্রমিকদের থাকার জন্য কেইপিজেড এলাকায় ১২টি ডরমেটরি নির্মাণ করা হবে, এর মধ্যে তিনটির কাজ চলছে।
প্রস্তুত জমিতে এখনই বিনিয়োগ আনা সম্ভব বলে মনে করছে কেইপিজেড। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা চুক্তি করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। কারণ এখনো জমির নামজারি হয়নি। কেইপিজেড বলছে, নামজারি ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জমি ইজারা নিতে চায় না। ১৯৯৯ সালে জমি বুঝিয়ে দেওয়া হলেও সরকার এখনো জমি নামজারি করে দেয়নি। বরং ২০১৫ সালে জাতীয় ভূমি ব্যবহার কমিটির একটি সভায় ২ হাজার একর জমি ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
অবশ্য এ বিষয়ে একটি মন্তব্যও করতে রাজি হননি কেইপিজেডের প্রেসিডেন্ট জাহাঙ্গীর সাদাত। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সহযোগিতা নিয়ে আমরা অদূর ভবিষ্যতে কেইপিজেডকে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমে নিতে পারব।’
কেইপিজেডের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে ১০০ একর জমিতে একটি তথ্যপ্রযুক্তিশিল্প এলাকা হবে। ১৪০ একর জমিতে একটি টেক্সটাইল-শিল্প এলাকা হবে। ওষুধশিল্পের জন্য জমি থাকবে ৫০ একর। এ ছাড়া কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও মাঝারি শিল্পের জন্য নির্ধারিত জমি থাকবে। সব মিলিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে মোট ব্যয় হবে ২০ কোটি ডলার। আর বিনিয়োগ আসবে প্রায় ১২০ কোটি ডলারের। সেখান থেকে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি হবে বলে আশা করছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।
কেইপিজেডের পৃষ্ঠপোষক কোম্পানি ইয়াংওয়ান করপোরেশন বাংলাদেশের পোশাক খাতে প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এটি ১৯৮৭ সালে প্রথম চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে কারখানা করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইয়াংওয়ানের ১৭টি শিল্প ইউনিট আছে। এতে কাজ করেন প্রায় ৬৫ হাজার কর্মী। বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশে ইয়াংওয়ানের কার্যক্রম আছে।
কেইপিজেডে কারখানা করতে কোরিয়ার ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং বাংলাদেশে এসেছিল বলে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কেইপিজেড কর্মকর্তারা জানান, স্যামসাং ২০০ একর জমি চেয়েছিল। তবে জমির নামজারি না হওয়ায় স্যামসাংয়ের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেনি কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। এরপরে আরও কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী এসে ফিরে গেছে জমির মালিকানার অবস্থা দেখে।
কেইপিজেড আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্র্যান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। যেসব কোরিয়ান কোম্পানি ভিয়েতনামে বিনিয়োগের চিন্তা করেছিল তারা এখন কম খরচের জন্য বাংলাদেশমুখী হবে।
কেইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিপিপি অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য কেইপিজেডে কয়েকটি ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার হবে। এখানে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে গবেষণা ও নকশা করা হবে। পাশাপাশি একটি আন্তর্জাতিক মানের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করা হবে।