বাংলাদেশে গার্মেন্টস কারখানার চলমান সংস্কারের অগ্রগতিতে ইউরোপের ক্রেতারা সন্তুষ্ট। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে এদেশের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে স্বস্তি তৈরি হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ক্রেতা, ক্রেতাদের জোট, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনও সংস্কারের এ অগ্রগতি স্বীকার করছেন। সমপ্রতি তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র উদ্যোগে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল নেদারল্যান্ডস সফর করেছে। দেশটি বাংলাদেশের পোশাকের অন্যতম বড় বাজার। প্রতিনিধি দলটি আমস্টারডামে অবস্থিত বাংলাদেশের কারখানা পরিদর্শন জোট অ্যাকর্ডের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ ছাড়া আলাদাভাবে বেশকিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হন। ওই সব বৈঠকে তারা রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর গার্মেন্টস কারখানার সংস্কারের অগ্রগতিতে তাদের এ সন্তোষের কথা জানান। আমস্টারডামে ওই সভায় অ্যাকর্ডের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স জরিস ওল্ডেনজিল বলেন, গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে অ্যাকর্ডভুক্ত প্রায় দেড় হাজার কারখানার সংস্কারে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এটি ধরে রাখা সম্ভব হলে ইউরোপের ক্রেতারা বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আস্থা পাবেন।
বিদেশে সরাসরি কিংবা পরোক্ষ রপ্তানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে, এমন প্রায় তিন হাজার সাতশ’ গার্মেন্টস কারখানার বর্তমানে সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতাদের কাছে রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২২শ’ কারখানার সংস্কারে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ কারখানাগুলোর সংস্কার দেখভাল করছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামে ক্রেতাদের আলাদা দুটি জোট।
আগামী বছরের জুন নাগাদ এসব কারখানার সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। তবে ইতোমধ্যে কিছু কারখানা তাদের সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পোশাক সরবরাহকারী আলোচ্য ২২শ’ কারখানার চিহ্নিত হওয়া ত্রুটির প্রায় ৭০ শতাংশ সংস্কার হয়েছে। অন্যদিকে সংস্কারে পিছিয়ে থাকা ও অসহযোগিতা করার অভিযোগে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ’ কারখানার সঙ্গে ব্যবসা বাতিল করেছে উভয় জোট।
তবে প্রাথমিক পরীক্ষায় মাত্র দুই শতাংশেরও কম কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর অর্থ হলো, ৯৮ শতাংশ কারখানা ভবনের কাঠামোই ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এসব কারখানা ভবনে কিছু ত্রুটি থাকলেও তা সংস্কারযোগ্য। ফলে বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের কারখানা নিয়ে স্বস্তি এসেছে।
সেই স্বস্তির বিষয়টিই স্বীকার করতে দ্বিধা করেন নি নেদারল্যান্ডসের ক্রেতা প্রতিনিধিরা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা। এর পর আর তাদের কার্যক্রম বাংলাদেশে চালু রাখার পক্ষে নন কারখানা মালিকপক্ষ ও সরকার। তবে আগামী বছরের পরও এ কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়ে অ্যাকর্ডের আগ্রহের কথা জানা গেছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করতে কাজ করছে অ্যাকর্ড। শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ দেখতে চায় অ্যাকর্ড। এ জন্য প্রয়োজনে আরো দুই কিংবা তিন বছর এটি চলমান রাখা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে বাংলাদেশে নিরাপদ কর্মপরিবেশের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও শ্রম অধিকারে আরো অগ্রগতি করতে হবে বলে স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। ওই সভায় অ্যাকর্ডের ব্র্যান্ড আউটরিচের প্রধান মিরিয়াম নিয়েল, বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির ছাড়াও দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সাবরিনা ওয়াল্টম্যান্স উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিনিধি দলটি আমস্টারডামে অবস্থিত ডেনিম সিটি’র হাউজ অব ডেনিম পরিদর্শন করেন। সেখানে হাউজ অব ডেনিমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যারিয়েট হোয়টিঙ্কের সঙ্গেও মতবিনিময় হয়। এছাড়া দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, শ্রমিক অধিকার সংগঠন ক্লিস ক্লথস ক্যাম্পেইন, গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল সংশ্লিষ্ট একাধিক বিভাগ ও ব্র্যান্ড প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় রানা প্লাজা ও তাজরীন দুর্ঘটনার পর কারখানা নিরাপদ করতে নানামুখী উদ্যোগ ও আলোচ্য সময়ে সংস্কারের অগ্রগতিতে তারা সন্তোষের কথা জানান। তবে তারা এটিও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, এ সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি শেষ হওয়ার নয়। এ অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা আশা করছেন, ২০১৮ সালের নির্দিষ্ট সময়সীমার আগেই এ সংস্কার কাজ সম্পন্ন হবে। তবে কারখানাগুলোকে সংস্কারের জন্য অনেক অর্থ বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানা উদ্যোক্তাদের জন্য এটি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির মনে করেন, আগামী বছরের জুনের আগেই অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানার সংস্কার কাজ সম্পন্ন হবে। কিন্তু বর্তমানে কারখানা উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকটে ভুগছেন। প্রতিটি কারখানা সংস্কারে গড়ে পাঁচ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে।
বিদেশি কিছু সংস্থা স্বল্প সুদে অর্থায়নের উদ্যোগ নিলেও সে প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় উদ্যোক্তারা কার্যত সে অর্থ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে তারা নামমাত্র সুদে অর্থায়ন করলেও বাংলাদেশে ঋণদানকারী ব্যাংকের হাত ঘুরে উদ্যোক্তার হাতে ওই অর্থ আসতে সুদের হার প্রায় ১০ শতাংশ হয়ে যাচ্ছে। ফলে এ তহবিল উদ্যোক্তাদের জন্য কাজে আসছে না।