Home বাংলা নিউজ ভবন বিড়ম্বনায় পোশাক শিল্প

ভবন বিড়ম্বনায় পোশাক শিল্প

সাভারের পলাশবাড়ীতে স্পেকট্রাম গার্মেন্টের নয়তলা ভবনটি ধসে পড়ে ২০০৫ সালে। প্রাণ হারান ৭০ জন পোশাক শ্রমিক। এর পর ২০১৩ সালে ধসে পড়ে রানা প্লাজা। সহস্র্রাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় পোশাক শিল্প মালিকদের। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বড় ধরনের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে খাতটি। পোশাক শিল্পের জন্য সর্বশেষ বিড়ম্বনা ডেকে এনেছে বিজিএমইএ কমপ্লেক্স। হাতিরঝিলে জলাশয় দখল করে গড়ে তোলা ভবনটি নিয়ে বিড়ম্বনার পাশাপাশি নতুন করে ভাবমূর্তি সংকটেও পড়েছে খাতটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্পটির বিস্তার ঘটেছে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে। ঘাটতি ছিল যথাযথ নজরদারি ও তদারকিরও। ফলে সার্বিকভাবে শিল্পটি এখনো কমপ্লায়েন্ট হয়ে উঠতে পারেনি। ভবন নিয়ে বিড়ম্বনা তাই কাটাতে পারছে না দেশের তৈরি পোশাক শিল্প।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, পোশাক শিল্পে ভবন বিড়ম্বনা রয়েছে। রানা প্লাজা ও বিজিএমইএ ভবন তার প্রমাণ। নিরাপত্তা বা কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো তদারকির দায়িত্ব যাদের, তাদের দায়িত্ব পালনে সহূদয়তা বা সততার ঘাটতি ছিল। ফলে নিয়ম ভাঙার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অনেকেই যা কাজে লাগিয়েছেন। যারা নিয়ম ভাঙার সুযোগ করে দিয়েছেন, আর যারা ভেঙেছেন— সব পক্ষই আজকের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

সব নিয়ম ভেঙে জলাশয় দখল করে গড়ে তোলা বিজিএমইএ ভবন খাতটির ভাবমূর্তিকে আরো একবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কারওয়ান বাজারে স্থাপিত বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ নিয়ে আপিল করেও শেষ পর্যন্ত রায় নিজেদের পক্ষে আনতে পারেনি বিজিএমইএ।

বিজিএমইএ ভবনের জমিটি ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের। পরবর্তীতে এর স্বত্ব চলে যায় বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হাতে। কিন্তু স্বত্ব বুঝে পাওয়ার আগেই বিজিএমইএর সঙ্গে এ জমি হস্তান্তরের চুক্তি করে ইপিবি। আদালতের রায় অনুযায়ী, এ হস্তান্তর প্রক্রিয়াটিই ছিল অবৈধ। সেক্ষেত্রে এ জমিতে ভবনটি গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে।

শুধু ভবন নির্মাণ নয়, অনিয়ম ছিল ভবনটির স্পেস বরাদ্দেও। ক্রয়-নিবন্ধন ছাড়াই স্পেস কিনে নিয়েছেন বিজিএমইএর সদস্য পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। ভবনটি ভেঙে ফেলার বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আসার পর থেকে এখন লগ্নি করা অর্থ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন তারা।

জানা গেছে, রাজধানীর হাতিরঝিলে স্থাপিত বিজিএমইএ ভবনটিতে স্পেস রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার বর্গফুট। স্পেসের মালিকানায় রয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও পোশাক শিল্প-কারখানার সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে শিল্প-কারখানা মালিকদের আধিক্যই বেশি, যার মধ্যে বিজিএমইএ পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান ও সাবেক নেতারাও রয়েছেন।

বিজিএমইএ ভবনে ফ্লোর রয়েছে মোট ১৫টি। সঙ্গে আছে বেসমেন্ট ১ ও ২। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় তলার আংশিক জায়গাজুড়ে রয়েছে বিজিএমইএ অডিটোরিয়াম, বাকি স্পেসে রয়েছে ঢাকা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের কার্যালয়। তৃতীয় ও চতুর্থ তলার পুরোটা এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার কিছু অংশের স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ। এছাড়া ১৪ ও ১৫তম তলারও পুরোটা বিজিএমইএর দাপ্তরিক, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়। বাকি সব ফ্লোরের স্পেস কিনে নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ভাঙার পর স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্তদের বিষয়টি কীভাবে সুরাহা হবে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

এর আগে বিজিএমইএকে সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় রানা প্লাজা নিয়ে। ধসে পড়ার সময় বিজিএমইএর সদস্য একাধিক প্রতিষ্ঠানের কারখানা ছিল ভবনটিতে। ধসের পর তদন্তে ভবন নির্মাণে ত্রুটির বিষয়টি উঠে আসে। দুর্বল অবকাঠামোর পাশাপাশি ভবনটির নির্মাণ অনুমোদনেও পাওয়া যায় দুর্নীতির অভিযোগ। বিশ্বব্যাপী সমালোচিত এ ঘটনাটি দেশের পোশাক খাতকে ফেলে দেয় দীর্ঘমেয়াদি বিড়ম্বনায়। পোশাক শিল্প মালিকরা ভবনটির মালিক না হলেও এ ঘটনার দায় দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে খাতটি।

রানা প্লাজা ধসের পর পরই শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ের (যেসব ভবনে একাধিক কারখানা একই সঙ্গে পরিচালনাধীন) কারখানাগুলোয় ক্রয়াদেশ দেয়া বন্ধ করে দেন ক্রেতারা। ফলে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় এসব ভবনে গড়ে তোলা পোশাক কারখানার মালিকদের। এ পরিস্থিতিতে

নতুন গন্তব্য বা নিজস্ব ভবনে কারখানা সরিয়ে নেন সামর্থ্যবান শিল্প মালিকরা। কিন্তু তুলনামূলক কম সামর্থ্যবান প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকগুলোই কাজের অভাবে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

রানা প্লাজা ধসের পরিপ্রেক্ষিতে কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রম নিরাপত্তা মূল্যায়নে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ শুরু হলে পোশাক খাতের এ ভবন বিড়ম্বনা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। পরিদর্শনে ত্রুটি শনাক্ত হয় অনেক ভবনেরই। এসব ভবনের ত্রুটি সংশোধন বা নতুন গন্তব্যে কারখানা স্থানান্তর ছাড়া আর কোনো উপায় নেই মালিকদের হাতে। বর্তমানে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় এ ধরনের অনেক বাণিজ্যিক ভবনই ফাঁকা পড়ে আছে।

জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের পর শুরু হওয়া মূল্যায়ন কার্যক্রমে দেশের সিংহভাগ কারখানা ভবনের স্থাপত্য থেকে শুরু করে অগ্নি ও বিদ্যুত্সংক্রান্তসহ নানা ত্রুটি বেরিয়ে আসে। খাত মূল্যায়নকারী পরিদর্শকদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা এসব ত্রুটি সময় অনুযায়ী সংশোধন না হওয়ায় দুই শতাধিক কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছেদ করে বিদেশী ক্রেতাদের প্রতিনিধিত্বকারী জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। ত্রুটি সংশোধনে ব্যর্থ এসব কারখানা এখন নতুন করে কোনো ক্রয়াদেশও পাচ্ছে না। এর মধ্যে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ সব ধরনের কারখানাই রয়েছে।

রানা প্লাজার আগে পোশাক কারখানা ধসের বড় ঘটনাটি ঘটে ২০০৫ সালে। স্পেকট্রাম গার্মেন্টের ভবন ধসে পড়লে এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় খাতটিকে। বয়লার বিস্ফোরণের পর ভবনটি ধসে পড়লেও এর স্থাপত্য কাঠামোয় দুর্বলতার বিষয়টিও তদন্তে বেরিয়ে আসে। একই সঙ্গে পাওয়া যায় অনিয়মের মাধ্যমে অতিরিক্ত ফ্লোর নির্মাণের প্রমাণও।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশেই কোনো শিল্প গড়ে ওঠার শুরুর দিকে অনেক অব্যবস্থাপনা থাকে, যার ফলে অনেক ত্রুটি রয়ে যায়। এগুলো পরবর্তীতে সংশোধনও করে নেয়া হয়। আমরা সে সংশোধন শুরু করেছি। রানা প্লাজা ও বিজিএমইএ ভবন দুটি দুই সময়ের ঘটনা। সংগঠনের ভবনের বিষয়ে কোনো অবস্থাতেই কোনো পক্ষ এককভাবে দায়ী নয়।