উত্তর-পশ্চিম আকাশে কালো মেঘে চিন্তিত রাখালের মতো কপালে ঘামের বিন্দু গার্মেন্ট মালিকদের। দিন দিন ব্যয় বাড়ার উল্টো পিঠে কমছে আয়। মেঘ চিড়ে সূর্যের দেখা কোনোভাবেই পাচ্ছেন না তারা। দিন দিন যেন ঝড়ের শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে। তবে গবেষণা প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী আশার দিক হলো, শত ঝঞ্ঝার মাঝেই এই শিল্প শক্ত ভিত গেড়েছে। তাই হার মানার পাত্র নন এই খাতের উদ্যোক্তারা।
দেশের প্রধান শিল্পখাতটির বর্তমান জটিল সমীকরণ মেলাতে ঘর্মাক্ত নেতৃবৃন্দের মাঝে ভর করেছে হতাশা ও ক্ষোভ। “আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নতুন সম্ভাবনা নেই”- ইনকিলাবের নিকট এমন মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএ’র সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান। হতাশা অন্য নেতাদের কণ্ঠেও। অথচ, গত কয়েক বছর ধরে বিজিএমইএ নেতাদের কণ্ঠে ছিল ভিন্ন সুর ও প্রত্যয়, “২০২১ সালের মধ্যে বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করবে বাংলাদেশ”।
গতকাল সন্ধ্যায় ফোনালাপে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “কোনো কারণে একবার একটি বাজার হারালে ওই বাজার ফিরে পাওয়া কষ্টকর। এছাড়া আমাদের সাথে যেসব দেশ প্রতিযোগিতা করে পোশাক রপ্তানি করছে, তারা দেশি-বিদেশি সুযোগ-সুবিধার কারণে এগিয়ে যাচ্ছে।”
“রানাপ্লাজা ধসের পর সংস্কার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন কারণে প্রায় দেড় হাজার পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া পোশাক রপ্তানিতে আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে ভারত। এর প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে।”
‘তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে মন্দাভাব যাচ্ছে’ উল্লেখ করে সিদ্দিকুর বলেন, “সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দেশে এ খাতের উন্নয়নের জন্য আলাদাভাবে পরিকল্পনা নেয়া এখন সময়ের জোর দাবি।”
ইনকিলাবের সঙ্গে ফোনালাপে জাতীয় অর্থনীতির হৃৎপিন্ড হিসেবে পরিচিত এই খাতটির নানা সংকটের দিক তুলে ধরেছেন বিজিএমই’র সিনিয়ির ভাইস প্রেসিডেন্টে মো: ফারুক হাসান। তিনি বলেন, “বিজিএমইএ ভবন ভাঙা নিয়ে যখন বিশ্ব মিডিয়ায় সংবাদ বের হবে, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশীয় মুদ্রার মান শক্তিশালী থাকায় ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে এখন পোশাকের দাম অনেক কম; কেনাবেচাও কমে গেছে। এছাড়া ব্যাংকের সুদের হার বেশি হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তাই খাতটি টিকিয়ে রাখতে বাড়তি প্রণোদনার ব্যবস্থা করা দরকার- এমন মত দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
নানা সংকটের মধ্যে সম্ভাবনার কথাও বলেছেন ফারুক হাসান। বলেন, এই শিল্পের ভবন ও শ্রমিকদের নিরাপত্তায় যে উন্নয়ন হয়েছে, এতে বিদেশিরা যথেষ্ট খুশি। এছাড়া পণ্যের আধুনিকায়নে চীনের প্রযুক্তি ব্যবহার করার নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, যে কারণে অদূর ভবিষ্যতে আশার আলো দেখছেন তিনি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অর্থ-বছরের প্রথম আট মাসে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮২ শতাংশ, যেখানে পাট ও চামড়ায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ ও ১০ শতাংশ। গার্মেন্টের এই প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ কম।
এই পরিসংখ্যানে হতাশ বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “পোশাক রপ্তানিতে আমরা স্বাভাবিকভাবেই ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে ধরে থাকি। তবে কেবল ফেব্রæয়ারির হিসাব ধরলে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ কমে গেছে।”
এই পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া, প্রত্যাশা অনুযায়ী চীনের সাবেক ক্রেতাদের দেশে আনতে না পারা, ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান, ডলারের বিপরীতে ইউরোর দুর্বল হওয়া এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ব্যর্থ হয়ে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়াকে দায়ী করেছেন এই সহ-সভাপতি। সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে আগামী চার মাসে তৈরি পোশাক শিল্পে ভালো কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না মাহমুদ হাসান।
“ডলারের বিপরীতে টাকাকে কিছুটা অবমূল্যায়িত করা হলে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। বর্তমানে কৃত্রিমভাবে টাকাকে শক্তিশালী করে রাখা হয়েছে। সরকারের উচিত এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা। এ ছাড়া পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।”
এ ব্যাপারে বিজিএমইএ সভাপতি
পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে আশার বাণী শোনাতে পারেননি গবেষকরাও। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, “রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নিম্নপর্যায়েই যেভাবে ওঠানামা করেছে, তাতে চলতি অর্থ-বছরে তো বটেই, ভবিষ্যতের লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হয়ে যাবে।” এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার পথও বাতলে দিয়েছেন এই সিনিয়র গবেষক। বলেছেন, “রপ্তানি বাজারের সমস্যা নিরূপণে সরকারকে শিল্প-উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এই পরিস্থিতিতেও আশার দিক হলো, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত সবসময় সংকটের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছে। তাই ভয় পাওয়ার খুব বেশি কারণ নেই- এমন মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেনের গবেষণা প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, গত সাড়ে তিন দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত চারটি বড় বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে। দুর্যোগ আর ঝুঁকির মধ্যে দিয়েই খাতটি সমৃদ্ধি লাভ করছে।
“এই ঝুঁকির মধ্যেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আরো বাড়বে। পুরনো ঝুঁকি চলে যাবে, নতুন ঝুঁকি আসবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত টিকে থাকার মতো যোগ্যতা দেখিয়েছে। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য পোশাক খাত প্রতি মুহূর্তে কাঠামো ও নীতিগত সংস্কারে মধ্যে দিয়ে গেছে। এই খাতের বড় শক্তি হলো দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তার সৃষ্টি।”