Home Bangla Recent অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স ঠেকাতে মালিক-শ্রমিক একজোট

অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স ঠেকাতে মালিক-শ্রমিক একজোট

পোশাক খাতে তথাকথিত সংস্কার

সংস্কারের নামে বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ন্ত্রণে বিদেশি ক্রেতাদের জোট- অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন মালিক ও শ্রমিকরা। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র নেতারা নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠক করেছেন। সরকারের সঙ্গেও বৈঠক করে ক্রেতা সংগঠন দুটির অযাচিত হস্তক্ষেপ ও অপতৎপরতার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন তারা। বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে বাংলাদেশে কোনোভাবেই দেখতে চান না, তা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকরা। পাশাপাশি এ ইস্যুতে মানববন্ধনসহ সভা-সমাবেশ করেছে এ খাতের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনও। এতদিন শ্রমিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে ক্রেতাজোট। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদেশি দুই ক্রেতাজোটের ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ড’র ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে সরকার।

প্রসঙ্গত, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তথাকথিত সংস্কার কাজের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৮ সালের ৩০ মে। কিন্তু ইতিমধ্যে এই মেয়াদ আরও তিন বছর অনুমোদন করেছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ প্রকাশ্যে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের বিরুেেদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। এই দুই সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য- সংস্কারের অজুহাত তুলে চিরস্থায়ীভাবে বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ন্ত্রণের নীলনকশা যে কোনো মূল্যে তারা প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। দুই ক্রেতাজোটের অযাচিত খবরদারি ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং পরিকল্পিতভাবে অহেতুক ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে পোশাক খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।

দেশের উদ্যোক্তাদের পঙ্গু, শত শত কারখানা বন্ধ ও লাখো শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ার বাস্তবতাও শ্রমিক সংগঠনের কাছে এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলে ‘জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন’ নামে শ্রমিকদের বড় একটি সংগঠনও গত মঙ্গলবার সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। ওই কর্মসূচিতে তারা ২০১৮ সালের মে মাসের পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সকে পুনরায় কাজের সুযোগ না দিতে সরকারের প্রতি দাবি তুলেছে। তাদের অভিযোগ, এদের ষড়যন্ত্রে শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ ও লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছেন। মনগড়া প্রতিবেদনের কারণে পোশাকের ন্যায্যমূল্য মিলছে না।’ এ ছাড়া ‘বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক-শিল্প ঐক্য’ নামের ২১টি গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠনের জোটও গত মে মাসে গার্মেন্ট নিয়ে দেশি-বিদেশিদের ষড়যন্ত্র অবিলম্বে বন্ধের দাবিতে সমাবেশ ও মানববন্ধন এবং র‌্যালি পালন করেছে।

এ পরিস্থিতিতে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার করেছেন। একাধিকবার এ বিষয়ে আলোচনায় বাণিজ্যমন্ত্রী যুগান্তরকেও বলেন, ভার্সন-২-এর নামে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স শ্রমিক অধিকার দেখভালের বিষয়টিও তদারকি করতে চাইছে। এ অজুহাতে ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে থাকতে চাইছে। যা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সময় হলেই সরকার এ বিষয়ে সময়োচিত পদক্ষেপ নেবে।’

জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে, সেটার ফল ভালো হয় না। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটতে পারে। এ দুই ক্রেতাজোট নিয়ে পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা যে ভীতির মধ্যে রয়েছেন তা দূর করতে বিজিএমইএ’র সব উদ্যোগে সহযোগিতা করবে এফবিসিসিআই।

বিজিএমইএ’র সহসভাপতি ও বাংলাদেশে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মালিকপক্ষের সমন্বয়ক মাহমুদ হাসান খান যুগান্তরকে বলেন, ‘অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের থাকা না-থাকার বিষয়ে আমরা গত ৩০ জুলাই জরুরি সাধারণ সভা (ইজিএম) ডেকেছিলাম। সেখানে সংগঠনের সব সদস্য উদ্যোক্তা উপস্থিত হয়ে ক্রেতাজোটের বিষয়ে তাদের মানোভাব পরিষ্কার করেছেন। সবাই তাদের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। আমরা ওই ইজিএমের সিদ্ধান্ত আগামী সপ্তাহের প্রথমদিকে বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রতিবেদন আকারে পৌঁছে দেব।’ তিনি বলেন, সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ভবিষ্যতে দেশে আরও নতুন শিল্প আসবে। সেসব শিল্পেরও সংস্কার হবে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, তার মানে কি তারা অন্ততকাল ধরেই বাংলাদেশে থাকবে?

বিকেএমইএ’র সাবেক ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, সরকার ও বিজিএমইএ’র সঙ্গে আলোচনা না করেই ওরা নির্লজ্জভাবে নিজেদের মতো করে প্রস্তাব পাস করে নিয়েছে। আবার বাংলাদেশে থেকে ওরা নেদারল্যান্ডসের আইনে কার্যক্রম চালাতে চাইছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ওরা এ সাহস দেখায় কী করে? ২০১৮ সালের পর কোনোভাবেই ওদের আর এ দেশে দেখতে চাই না। এর জন্য তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ রাখেন। কারণ ওদের শতভাগ শর্ত কখনও পূরণ হবে না। হাজারবার পূরণ করলেও ওরা বলবে এটা বাকি। ওটা করতে হবে।’

জানা গেছে, এতদিন শুধু ভুক্তভোগী মালিকপক্ষই ক্রেতাজোটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযোগ তুলে ধরতেন। এখন তা কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের গোমর ফাঁস করছেন পোশাক শিল্পের ছোট, মাঝারি ও বড় কারখানার মালিক এবং সাধারণ থেকে তারকা উদ্যোক্তারাও।

এদের অযাচিত খবরদারিতে ত্যক্ত-বিরক্ত উদ্যোক্তারা সম্প্রতি বিজিএমইএ আয়োজিত এক বিশেষ সাধারণ সভায় (ইজিএম) ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সকে চরমভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেন। এওই সময় উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ দুই ক্রেতাজোটকে অবিলম্বে তাড়াতে সরকার ও বিজিএমইএ নেতাদের প্রতিও আহ্বান রাখেন। তারা দাবি করেন, সংস্কার তদারকির জন্যও তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। এখনই ওদের তাড়ানোর ব্যবস্থা না নিলে ওরা পেয়ে বসবে। তারা আরও বলেন, এখন তিন বছর চেয়েছে। পরে আরও তিন বছর চাইবে। এভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো চিরস্থায়ী থেকে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে চাইছে ওরা। এটা কোনোভাবেই আমরা মানতে পারি না।

জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, এরা (ক্রেতাজোট) বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এদের কারণে দেশে বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় প্রায় শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ৬৪টি কারখানা। এতে লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এদের কারণে শুধু শ্রমিকরাই বেকার হননি, মালিকরাও ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। এটি কোনো সংস্কার উদ্যোগ নয় বরং এ দেশের পোশাক শিল্পের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির সময়সীমা শেষ হওয়ার পর কোনোভাবেই যাতে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বাংলাদেশে কাজ করার সুযোগ না পায় সে বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপও কামনা করেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক-শিল্প ঐক্যের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে পাওয়া জিএসপি সুবিধা তুলে নেয়ার প্রচেষ্টা নেহায়েত সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। এটা দেশি-বিদেশিদের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রেরই অংশ।

এদিকে বিজিএমইএ’র বিশেষ সাধারণ সভায় দুই ক্রেতাজোটের স্বেচ্ছাচারিতার নানাদিক উল্লেখ করে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ওদের পরামর্শ মানতে হচ্ছে, এটাই বাস্তবতা। না মানলে অ্যাকর্ড বায়ারদের সঙ্গে ব্যবসা করা যাচ্ছে না। আবার মানতে গিয়েও আর্থিক সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মানসিক ধৈর্য হারানোর উপক্রম হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। ট্রেড ইউনিয়ন নিয়েও এখন যে হস্তক্ষেপের কথা বলছে সেটা তারা পারে না। বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নিয়ে সবারই ব্যথা আছে। কারও কম, কারও বেশি। একটা সময় ছিল কিছু বলার ছিল না। এখন বাংলাদেশ বিশ্বের তৈরি পোশাক কারখানায় নিরাপদ দেশগুলোর অন্যতম। তাই কারও কাছে মাথানত আমরা করব না। ব্যবসা করলে সম্মান নিয়েই করব। সাধারণ সদস্যরা যা পরামর্শ দিয়েছেন তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে। বিজিএমইএ পরিচালক আরশাদ জামান দিপু বলেন, এ ইস্যুতে এখনই শক্ত অবস্থান নেয়া জরুরি। নইলে চুপ থাকাকে ওরা দুর্বলতা ভাববে। তাই এটা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করারও পরামর্শ দেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here