কোরবানি ঈদের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে সাভার শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারে নতুন দুটি মডিউল চালু করা করা হয়েছে। এর ফলে আগের দুটিসহ মোট চারটি মডিউলে দৈনিক ২৫ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব। ইতোমধ্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রথম ধাপ অর্থাৎ ওয়েট ব্লু চামড়া তৈরির লক্ষ্যে ৭৮টি ট্যানারি চালু করা হয়েছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ৯১টি ট্যানারি পুরোপুরি শতভাগ চামড়া উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যে অবকাঠামোর কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। হাজারীবাগের তুলনায় সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রতিটি ট্যানারিতে উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেড়েছে। কোরবানির চামড়া নষ্ট কিংবা পাচার যাতে নয়, সে লক্ষ্যে উৎপাদনক্ষম ট্যানারিগুলো সারাক্ষণ চালু রাখছেন উদ্যোক্তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
জানা গেছে, কাঁচা চামড়া থেকে পরিশোধনের প্রথম পর্ব বা ওয়েট ব্লু চামড়া উৎপাদনই হচ্ছে ট্যানারিগুলো মূল কাজ। ওয়েট ব্লু চামড়া বানানোর পর বিদেশী ক্রেতাদের অর্ডার মতো ফিনিশড চামড়া তৈরি করা হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় ক্রেতাদের চাহিদা মতো ট্যানারি মালিকরা সরাসরি ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানি করে থাকেন। ইতোমধ্যে কোরবানির সময় সংগৃহীত কাঁচা চামড়াগুলোর প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আবু বকর সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে বাকি দুটো মডিউল অস্থায়ী ভিত্তিতে চালু করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে দৈনিক ২৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, ৭১টি ট্যানারি থেকে যে বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে সার্বক্ষণিক চারটি মডিউল চালু রাখার প্রয়োজন হয় না। তবে ১৫৪টি ট্যানারি চালু হলে চারটি মডিউল চালু রাখতে হবে। এবার কোরবানি ঈদে যেসব চামড়া সংগৃহীত হয়েছে তা সাভারের প্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব। এ কারণে চামড়া নষ্ট হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। তিনি আরও জানান, হাজারীবাগের তুলনায় সাভারে প্রতিটি ট্যানারির উৎপাদন ক্ষমতা কয়েকগুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
জানা গেছে, গত বছর কোরবানিতে জবাইযোগ্য পশু ছিল প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ। এর মধ্যে গরু ও মহিষ ছিল প্রায় ৩৩ লাখ। বাকিটা ছাগল, খাসি, ভেড়াসহ অন্যান্য পশু। এবার এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে। হাজারীবাগের ২০৫টি ট্যানারির মধ্যে ১৫৫টি ট্যানারি নতুন চামড়াশিল্প নগরে জমি পেয়েছে। তবে বরাদ্দ বাতিল ও দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ায় সাভারে স্থানান্তর হওয়ার কথা মূলত ১৫১টি ট্যানারির। এর মধ্যে ৭১টি ট্যানারি ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। এসব ট্যানারির উৎপাদনক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে মদিনা লেদার কমপ্লেক্সের এক কর্মকর্তা জানান, হাজারীবাগে তাদের তিনটি ড্রামে দিনে ৩০০ চামড়ার ওয়েট ব্লু করা যেত। আর এখানে আটটি ড্রামে দিনে ৭০০ চামড়া প্রক্রিয়াকরণ সম্ভব হচ্ছে।
জানা গেছে, গরু জবাইয়ের পর চামড়া ছাড়িয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাতে লবণ দিতে হয়। এসব লবণযুক্ত চামড়া ট্যানারিতে কেটে একটি আকার দেয়া হয়। এ পর্যায়ে লেজ, মাথা ও পায়ের অংশ কেটে ফেলা হয়। এরপর প্রায় ৩০ ধরনের রাসায়নিক দিয়ে ট্যানিং ড্রামে চামড়ার প্রক্রিয়া করা হয়। এতে পশম দূর হয়ে যায়। ড্রাম থেকে চামড়া বের করে ঝিল্লি ও চর্বি অপসারণ করে ওয়েট ব্লু চামড়া উৎপাদিত হয়। এরপর ক্রাস্ট লেদার উৎপাদনে প্রায় ৫০ রকম রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এ পর্যায়ে ক্রেতাদের চাহিদামতো চামড়া রং করা হয়। সর্বশেষ চামড়ার সাজসজ্জা করা হয়। এতেও ১৫ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একে বলে ফিনিশড পর্যায়। এই চামড়া দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয় কারখানায়।
প্রসঙ্গত, গত ২০০৩-০৫ সাল মেয়াদী বিসিক চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে। নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় প্রথমে ২০১০ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৫৪৫ কোটি। ওই সময়ের মধ্যেও নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়ায় সর্বশেষ ২০১৬ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। বুয়েটের তত্ত্বাবধানে চীনা কারিগরি সহায়তায় সিইটিপি বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে। গত গত ৮ এপ্রিল পরিবেশ অধিদফতরের অভিযানে হাজারীবাগের ট্যনারিগুলোর বিদ্যুত, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এর পরের দিন ৯ এপ্রিল রবিবার মহামান্য আদালত ১৫ দিনের মধ্যে সাভারের শিল্পনগরীতে সব ধরনের সংযোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশ পাওয়ার পর ট্যানারিগুলো সাভারে সরে যেতে শুরু করে।