দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কর্মরত ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স আগামী বছর তাদের কার্যক্রম গোটাবে, বিশেষ করে অ্যাকর্ডের মেয়াদ নতুন করে তিন বছর বাড়ছে না—এমন সিদ্ধান্তে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। অবশেষে ‘অ্যাকর্ড’ নামক পাথরটি বুকের ওপর থেকে নামছে ভেবে ফুরফুরে মেজাজে আছেন অনেক কারখানার মালিক।
অ্যাকর্ড থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার আগে দুই জোটের দায়িত্ব বুঝে নিতে বাংলাদেশকে জোরেশোরে প্রস্তুতি নিতে হবে। নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। অন্যথায় ছয় মাস করে সময় বাড়ানোর পথেই হাঁটবে অ্যাকর্ড। অ্যালায়েন্সও যে একই পথের ট্রেন ধরবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ উত্তর আমেরিকার এই জোটের কর্তাব্যক্তিরা বেশ কয়েকবার পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতাদের বলেছেন, কেবলমাত্র স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য সংস্থার কাছেই দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান তাঁরা।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবে রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন বা সংস্কারকাজ সমন্বয় সেল (আরসিসি)। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) একটি প্রকল্পের মাধ্যমে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে পরিচালিত হবে আরসিসি। মোদ্দা কথা, শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছে নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও গত পাঁচ মাসে আরসিসির কার্যক্রম শুরুই হয়নি। কারণ আইএলওর ৪৭ জন প্রকৌশলী দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো দেয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্পের পাঁচ কোটি টাকাও ছাড় হয়নি। ফলে দুই জোটের দায়িত্ব বুঝে নিতে আরসিসির সক্ষমতা অর্জন তো দূরের কথা, অঙ্কুরোদ্গম ঠিকমতো হয়নি।
সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও এনটিএপির অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সাড়ে তিন হাজারের বেশি কারখানা পরিদর্শন করে অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সদস্য কারখানার যথাক্রমে ৭৮ ও ৮৪ শতাংশ সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে। আর অধিদপ্তরের কারখানার সংস্কারকাজ হয়েছে সর্বসাকল্যে ২০-২৫ শতাংশ।
সংস্কারকাজে অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। ফলে উভয় জোটের সদস্য কারখানাগুলো ব্যবসা হারানোর চাপে সংস্কারকাজ দ্রুত করেছে। তবে ডিআইএফইএর অধীনে কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টা এমন, চাপ নেই তো কাজ নেই। ফলে আরসিসি কাজ শুরু করলে সংস্কারকাজে কতটুকু অগ্রগতি হবে, সেটি নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। আর সংস্কারকাজে অগ্রগতি দেখাতে না পারলে আরসিসি দুই জোটের দায়িত্ব নিতে সক্ষম, সেটি জোর গলায় কিছু বলা মুশকিল হবে।
গত সপ্তাহে সরকার ও বিজিএমইএর সঙ্গে অ্যাকর্ডের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জোটের মেয়াদ নতুন করে তিন বছর বাড়ছে না। তবে অ্যাকর্ডের দায়িত্ব বুঝে নিতে আরসিসিকে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। না হলে ছয় মাস করে সময় বাড়বে। কিন্তু আরসিসিকে কী ধরনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, সেটি পরিষ্কার করা হয়নি। এমনকি বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, প্রয়োজন হলে বর্তমান মেয়াদ শেষে অন্তর্বর্তীকালীন অ্যাকর্ড হবে। তার মানে সময় বাড়লেও জোটের পুরোনো নিয়মকানুনই প্রযোজ্য হবে।
অবশ্য স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ক্রিস্টি হফম্যান বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ যত দিন না অ্যাকর্ডের দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রস্তুত হবে, তত দিন সম্মত হওয়া শর্তাবলির ভিত্তিতে ‘২০১৮ অ্যাকর্ড’-এর কার্যক্রম পরিচালিত চলবে। সেটি হলে পোশাক খাতের সরবরাহ ব্যবস্থায় থাকা সুতা, বস্ত্র, সরঞ্জাম ও মোড়কীকরণ পণ্য উৎপাদনের কারখানা পরিদর্শন ও কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতার বিষয়টি তদারকি করার অধিকার পাবে জোট।
আরসিসির সক্ষমতা অর্জন বিলম্ব হলে অ্যাকর্ড মেয়াদ কমপক্ষে ছয় মাস বাড়বে। তখন যদি আবার জোটের নতুন নিয়মকানুন চালু হয়, তাহলে বর্তমান অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া ও আস্থার জায়গা তৈরি না করতে পারলে নতুন করে ভোগান্তিতে পড়তে হবে কারখানার মালিকদের।
রানা প্লাজা ধসের পর দেশের পোশাকশিল্প নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা প্রচারিত হয়। তখন অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে অংশ ও তাদের প্রেসক্রিপশন মেনে সংস্কারকাজ করে কারখানাগুলো নিরাপদ কারখানার সনদ পায়। দুর্ঘটনাও কমেছে। ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠছে। অর্জনটি ধরে রাখতে হলে শক্ত তদারকি ব্যবস্থা দরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার সেটি কতটুকু পারবে? কারখানার মালিকেরা কি নিজেরা উদ্যোগী হবেন?
অ্যাকর্ডের কিছু কর্মকাণ্ডে মালিকেরা অতিষ্ঠ হয়েছেন। ঘটনা অনেক ক্ষেত্রে সত্য। তাই বলে যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে উভয় জোটের দায়িত্ব নেওয়া হবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। কারণ অবহেলার কারণে ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটির ক্ষত অনেক দূর বয়ে বেড়াতে হবে। হয়তো তখন যে অ্যাকর্ড আসবে, সেটি চিরদিনই রয়ে যাবে। তাই এখন মালিকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কোন দিকে যাবেন?