দেশের পোশাক শিল্পখাতে চলছে পরিবারতন্ত্রের দাপট। এ খাতটির পরিচালনায় শতকরা ৮৯ শতাংশই পরিবারতন্ত্রের দখলে বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ডের অধিকাংশই একই পরিবারের সদস্য। পোশাকখাতে পুরুষ ও নারীর মজুরির ক্ষেত্রে গড়ে তিন শতাংশ বেতন বৈষম্য রয়েছে। এখানে পুরুষদের গড় বেতন ৭ হাজার ২৭০ টাকা, অপরদিকে নারীদের গড় বেতন ৭ হাজার ৫৮ টাকা। সিপিডির মতে, দেশে তৈরি পোষাকশিল্পের ১৬ ভাগ কারখানায় বিদেশী শ্রমিকরা উচ্চ পদে-উচ্চ বেতনে কাজ করছেন। এদের মধ্যে প্রোডাকশন প্লানিংয়ে ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ, মার্চেন্টডাইজিংয়ে ২০ দশমিক ১ শতাংশ এবং কোয়ালিটি এ্যাসুয়ারেন্সে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ওয়াশিং সেক্টরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ বিদেশী শ্রমিক কাজ করছে।
শনিবার রাজধানীর গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। এ সময় সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, সিপিডির রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাবেক শ্রম সচিব মিকাইল শিপার, বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে শামীম, শ্রমিক নেতা বাবুল আকতার, সামসুন নাহার উপস্থিত ছিলেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ১৯৩টি কারখানার ২ হাজার ২৭০ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে পোশাকখাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। বিপরীতে ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সে হিসেবে চার বছরে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে দশমিক ৭১ শতাংশ। সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাও কমেছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবারতন্ত্রে পরিচালিত বোর্ডের হার শতকরা ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ডের অধিকাংশই একই পরিবারের সদস্য। পোশাকখাতে পুরুষ ও নারীর মজুরির ক্ষেত্রে গড়ে তিন শতাংশ বেতন বৈষম্য রয়েছে। এখানে পুরুষদের গড় বেতন ৭ হাজার ২৭০ টাকা, অপরদিকে নারীদের গড় বেতন ৭ হাজার ৫৮ টাকা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশে পোশাকখাতে সামাজিক অগ্রগতি হলেও অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি পিছিয়েছে। এ সময় নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য কমলেও নারী কর্মসংস্থানের হার কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রযুক্তি ব্যবহারে বড় কারখানাগুলো এগিয়ে রয়েছে। আর ছোট কারখানাগুলো আরও পিছিয়েছে। এছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারে পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। তবে ট্রেড ইউনিয়নের অবস্থা দুর্বল হলেও শ্রমিক সংগঠনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
রেহমান সোবহান বলেন, পোষাক শিল্পের এই সম্ভাবনাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এ খাতে শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে ঐক্য না থাকায় তারা তাদের দাবি দাওয়ার বিষয়ে জোরালভাবে তুলে ধরতে পারছে না। পোষাক শিল্পে ৭০টির বেশি সংগঠন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিভক্তি থাকায় ন্যায্য দাবি আদায় হচ্ছে না। পোষাকখাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এ খাতের আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের ডেকে সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে রেহমান সোবহান আরও বলেন, এতে করে তারা বাংলাদেশের পোষাকখাতে আরও বেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর পোশাকখাতের সামাজিকভাবে অগ্রগতি হয়েছে। ২০ শতাংশ পোশাক কারখানায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগ থেমে থাকেনি। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি হয়নি। তিনি বলেন, কারখানার মান বেড়েছে, প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে এগুলো পোশাকখাতের সামাজিক অগ্রগতি অপরদিকে শ্রমিক নিয়োগের হার কমেছে, প্রবৃদ্ধি হার তুলনামূলক কমেছে এগুলো অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, গবেষণায় প্রধান পাঁচটি অংশ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরে আমাদের পোশাকখাতে বড় কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। সেটাকে সামনে রেখে একটি নমুনা জরিপ পরিচালনা করা। ১৯৩টি প্রতিষ্ঠান ও দুই হাজারের ওপর শ্রমিকদের নিয়ে এ নমুনা জরিপ পরিচালিত হয়েছে। উৎসাহব্যঞ্জক ফলাফল হচ্ছে রানা প্লাজাউত্তর পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ থেমে থাকেনি, নতুন নতুন পোশাক কারখানা হচ্ছে। এমনকি কারাখানা পর্যায়ে কিছু পরিবর্তন আসছে। যেমন- ব্যক্তি মালিকানা থেকে গার্মেন্টেস লিমিটেডে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, রানা প্লাজা উত্তর পরিস্থিতিতে ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা পরিবর্তন করলেও এখনও ১২ শতাংশের মতো কারখানা পুরাতন ভবনে রয়েছে। অন্যদিকে ১৬ শতাংশের মতো বিদেশী কর্মকর্তা এখাতে কাজ করছেন। এ সময় তিনি বলেন, পোশাক কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়নের উপস্থিতি কম এবং দুর্বল। কল্যাণ সংঘ তুলনামূলকভাবে ক্রমন্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ৪ হাজার উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষিত লোক বের হচ্ছে। কিন্তু পোষাকখাতে চাহিদা অনেক বেশি হওয়ায় বিদেশী কর্মকর্তারা এখানে কাজ করছে।
সাবেক সচিব মিকাইল শিপার বলেন, বর্তমানে দেশে ছোট ছোট কারখানাগুলো নিজেরাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এটা ভাল দিক, কারণ এসব কারখানায় কমপ্লাইন্স মানা হত না। শ্রমিক নেতা বাবুল আকতার বলেন, বাংলাদেশের পোষাকশিল্পে ভারত ও শ্রীলঙ্কার অনেক শ্রমিক কাজ করছে। তারা অনেক টাকা এই দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা কৌশলে বিদেশে টাকা পাচার করার শামিল।