পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ ও শ্রমনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় পরিদর্শন ব্যবস্থায় দুর্বলতার চরম প্রকাশ ঘটে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। সে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি পোশাকের ক্রেতা ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার সংস্থার সমন্বয়ে গঠন হয় একাধিক জোট। এর একটি হলো ইউরোপভিত্তিক জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ (অ্যাকর্ড)। এর পূর্ব ঘোষিত মেয়াদ প্রায় শেষ। কিন্তু সহসাই জোটটির প্রভাবমুক্ত হতে পারছে না বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অ্যাকর্ড থেকে মুক্ত হওয়ার যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই দেশের।
২০১৩ সালে কর্মসূচি ঘোষণার পর পোশাক শিল্পমালিকরা অ্যাকর্ডের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। পরে সমালোচকদের তালিকায় যোগ দেন সরকারসংশ্লিষ্টরাও। কিন্তু শিল্প বিপর্যয়ে প্রাণহানির ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটে নিরবচ্ছিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এগোতে থাকে অ্যাকর্ড। চলতি বছরের জুনে অ্যাকর্ডের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রম এখনই শেষ হচ্ছে না। এরই মধ্যে কর্মসূচি সম্প্রসারণের ঘোষণা দিয়েছে তারা। এ ঘোষণার প্রতিরোধমূলক তত্পরতাও দেখা গেছে।
তবে তত্পরতা থাকলেও নিজস্ব জাতীয় পরিদর্শন ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে পোশাক কারখানার মানোন্নয়ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারেননি সরকারি ও বেসরকারি খাতসংশ্লিষ্টরা। ফলে নতুন নামে হলেও কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিতে হচ্ছে তাদের। পোশাক খাতে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিয়ে ট্রানজিশন অ্যাকর্ড নামে কর্মসূচি সম্প্রসারণ করতে যাচ্ছে বর্তমান অ্যাকর্ড।
পোশাক কারখানায় মানোন্নয়ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতা রক্ষায় জাতীয় সক্ষমতার দুর্বলতার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে সাম্প্রতিক বেশকিছু ঘটনার মাধ্যমে। সম্প্রতি একটি ট্রানজিশন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার কাজ হবে দায়িত্ব হস্তান্তরে বাংলাদেশের জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রস্তুতি যাচাই করা। অন্যদিকে অ্যাকর্ডের পক্ষ থেকে বিজিএমইএ ও সংগঠনটির হাত ঘুরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে যাওয়া এক চিঠিতে ট্রানজিশন অ্যাকর্ড নামে বর্তমান অ্যাকর্ডের কার্যক্রম সম্প্রসারণে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর একজন মালিক প্রতিনিধি বণিক বার্তাকে বলেন, অ্যাকর্ডের কর্মসূচি সম্প্রসারণের বিষয়টি আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তাদের কারখানার কর্মপরিবেশসংক্রান্ত কর্মসূচিগুলোর কারণে কারখানামালিকদের অবকাঠামোগত ব্যয় বেড়েছে। অবশ্য টেকসই শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে তাদের কর্মসূচিগুলো গ্রহণযোগ্য। কারখানার মান উন্নত রাখতে এসব কর্মসূচির নিয়মিত নজরদারি ও তদারকির ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। কিন্তু প্রচলিত পরিদর্শন ব্যবস্থায় সে সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। কল-কারখানা পরিদর্শনে সরকারি সংস্থার সক্ষমতা কিছুটা বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনো অনেক কম। এ কারণেই ট্রানজিশন অ্যাকর্ড নামে বর্তমান অ্যাকর্ডের কর্মসূচি সম্প্রসারণে প্রাথমিকভাবে ছয় মাস সময় দেয়া হবে। সক্ষমতার দুর্বলতার কারণে পরে অ্যাকর্ডের সময় আরো বাড়ানো হতে পারে বলে জানান তিনি।
উত্তর আমেরিকাভিত্তিক অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি ও ইউরোপভিত্তিক অ্যাকর্ডের পাশাপাশি জাতীয় উদ্যোগেও মূল্যায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছিল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। জাতীয় উদ্যোগের এ কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় গঠন হয় রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল বা আরসিসি। অ্যাকর্ডের দায়িত্বগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে বিজিএমইএ একটি ভিন্ন প্লাটফর্মের দাবি তুললেও সরকারের লক্ষ্য ছিল আরসিসি শক্তিশালী করা। এর মাধ্যমেই অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ডের ধারাবাহিকতা রক্ষার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে আরসিসির প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় উদ্যোগের কর্মসূচিটি পরিচালিত হচ্ছিল আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে। আরসিসি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয় এ অর্থায়ন সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতিতে। কিন্তু এখন অর্থসংস্থান না হওয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে আরসিসি শক্তিশালী করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সভায় নিজস্ব অর্থায়নে আরসিসির কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি উল্লেখ করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু বিজিএমইএর হাত ঘুরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে যাওয়া ওই চিঠিতে আরসিসির প্রস্তুতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।
অ্যাকর্ডের বিজনেস লাইসেন্স ও অফিস অনুমোদনসংক্রান্ত বিষয়ে ২৪ মার্চ বিজিএমইএকে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি ১ জুন আরসিসিকে প্রস্তুত হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়, তবুও অ্যাকর্ডের দায়িত্ব হস্তান্তরে ছয় মাস সময় লেগে যাবে। এ কারণেই অ্যাকর্ডের বিজনেস লাইসেন্স নবায়নের ব্যাপারে বিজিএমইএ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে। কিন্তু ছয় মাস নয়, বরং ২০২১ সাল পর্যন্ত অ্যাকর্ড বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে মত প্রকাশ করছেন জাতীয় ট্রানজিশন মনিটরিং কমিটির সদস্যরা।
কমিটির সদস্য ও ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) মহাসচিব মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, আরসিসি বা ডিআইএফইর মতো জাতীয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ছয় মাসের মধ্যে দায়িত্ব নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে এখনই মন্তব্য করা যাবে না। তবে বাস্তবতার নিরিখে এটা বলা যায়, ছয় মাস নয়, পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সাল পর্যন্ত অ্যাকর্ডের কর্মসূচি চলবে। আর এর কারণ হলো জাতীয় কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার সক্ষমতার দুর্বলতা।
তিনি বলেন, শ্রম অধিকার ইস্যুতে মালিকরা অ্যাকর্ডের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু টেকসই কারখানা গড়ে আন্তর্জাতিক সুনাম ফিরিয়ে আনতে অ্যাকর্ডের ভূমিকা মালিকদের কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। আমাদের কারখানাগুলোর নিজস্ব ঘাটতি এখনো দূর হয়নি। এছাড়া শুধু মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতা থেকেও সরে আসা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই আমাদের পোশাক খাতে আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।