দেখতে হুবহু পলিথিনের মতো। কিন্তু এগুলো পলিথিন তো নয়ই, কোনো রকম প্লাস্টিক উপকরণও নেই এতে। ব্যাগগুলো বানানো হয়েছে কেবলই পাটের আঁশ ব্যবহার করে। এই আঁশ থেকে পচনশীল পলিমার ব্যাগ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের এক বিজ্ঞানী। আমদানি করা যেসব পচনশীল পলিমার ব্যাগ বাজারে পাওয়া যায়, তার ৫ ভাগের ১ ভাগ দামেই এটি পাওয়া যাবে।
রাজধানীর ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণে তৈরি হচ্ছে এ পলিমার ব্যাগ। আয়োজন চলছে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার। কিন্তু এরই মধ্যে দেশের ভেতরে, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্পমালিকেরা এ ব্যাগ কেনার জন্য বায়না দিতে শুরু করেছেন। দেশের বাইরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকেও এ ব্যাগের চাহিদা আসছে।
পাটের তৈরি এ পলিব্যাগ দেখতে বাজারের সাধারণ পলিথিন ব্যাগের মতো হলেও এটি অনেক বেশি টেকসই ও মজবুত। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা এ পলিব্যাগ কয়েক মাসের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে এটি পরিবেশ দূষণ করে না। এটিকে তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
পাটের আঁশ থেকে পলিমার তৈরির এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোবারক আহমদ খান। ২০ বছর ধরে তিনি পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করছেন। এই পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি তাঁকে ২০১৫ সালে স্বর্ণপদক দেয়। ২০০৯ সালে এই বিজ্ঞানী পাটের সঙ্গে পলিমারের মিশ্রণ ঘটিয়ে মজবুত, তাপ বিকিরণরোধী ও সাশ্রয়ী ঢেউটিন ‘জুটিন’ বানান।
একই প্রযুক্তি ও কাঁচামাল ব্যবহার করে তিনি হালকা অথচ মজবুত হেলমেট, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের রিং, স্ল্যাব, চেয়ার, টেবিল, টাইলসসহ বেশ কয়েকটি নিত্যব্যবহার্য পণ্য তৈরি করেছেন।
ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে সরকারি পাটকল লতিফ বাওয়ানী জুট মিল। দেয়ালঘেরা কারখানা চত্বরে পাটের ব্যাগ তৈরির ব্যস্ততা। ঘটরঘটর শব্দে চলছে পাটকলের যন্ত্রপাতি। বাতাসে চটের সতেজ গন্ধ। এই কর্মযজ্ঞ পেরিয়ে পূর্ব দিকের একটি কোণে একটি আয়তাকার গুদামঘরে চলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম আরেক ব্যস্ততা। দরজা দিয়ে ঢুকলে মনে হবে কোনো রসায়নবিদের গবেষণাগার। সেখানে বড় বড় যন্ত্রপাতিতে চলছে অধ্যাপক মোবারক আহমদ খানের পলিমার তৈরির কাজ। যন্ত্রগুলো সবই দেশে তৈরি।
যেভাবে তৈরি হচ্ছে পাটের পলিমার
পাটকলে ফেলে দেওয়া পাটের আঁশ থেকে প্রথমে সূক্ষ্ম সেলুলোজ আহরণ (এক্সট্রাকশন) করে আলাদা করে নেওয়া হয়। পানিতে অদ্রবণীয় এই সেলুলোজকে পরে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিবর্তন (মডিফিকেশন) করা হয়। দ্রবণীয় সেলুলোজের সঙ্গে ক্রসলিঙ্কার মেশানো হয়। বিশেষ তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দ্রবণটি ড্রায়ার মেশিনের ভেতরে পরিচালিত হয়। তাতে তা শুকিয়ে প্লাস্টিকের শিটের আকারে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে। পরে শিট কেটে চাহিদামতো পলিব্যাগের আকার দেওয়া হয়।
কী রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় এবং কত তাপমাত্রায় এই পলিব্যাগ তৈরি হয়-এমন প্রশ্নে বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো বলা যাবে না, এটাই তো বিজ্ঞানীর ফর্মুলা।’
পলিথিন ব্যাগ ও পাট-পলিমারের পার্থক্য
যান্ত্রিক শক্তিমত্তা পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাটের তৈরি পলিমারের ব্যাগ সাধারণ পলিব্যাগের চেয়ে দেড় গুণ টেকসই ও মজবুত। মাটি চাপা পড়লে পাট পলিব্যাগ চার থেকে পাঁচ মাস পর পচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে। পানিনিরোধক এই পলিব্যাগ দামেও খুব একটা বেশি নয়। এক কেজি পলিথিন ব্যাগের বাজারমূল্য যেখানে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, সেখানে এক কেজি পচনশীল পাটের পলিব্যাগের দাম পড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের পর বাজারে এলে আরও দাম কমবে বলে উদ্ভাবকের আশা।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বিজেএমসির তত্ত্বাবধানে গত বছরের ১২ মে ঢাকার ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পাটের পলিব্যাগ তৈরির পাইলট প্ল্যান্ট উদ্বোধন করা হয়। পাটের পলিব্যাগ তৈরি করতে সেখানে সেমি অটোমেটিক প্ল্যান্টে সেলুলোজ এক্সট্রাকশন মেশিন, রিঅ্যাকশন চেম্বার, কাস্টিং মেশিন, কাটিং অ্যান্ড প্রিন্টিং মেশিন ও প্যাকেজিংয়ের ভারী যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে এখন চলছে প্রতিদিন ১ হাজারের বেশি পাট পলিব্যাগ উৎপাদন।
বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে, পাইলট প্রকল্প শেষে সরকার এখন পলিব্যাগের বিকল্প হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে পাটের ব্যাগ তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে স্থাপন করা হয়েছে। আগামী বছরের শুরুর দিকে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার পলিব্যাগ তৈরি করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে।
বিশ্বজুড়ে চাহিদা
ডেনমার্কের কোপেনহেগেনভিত্তিক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস’ বলছে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে একটার পর একটা রাখা হলে প্রতি ঘণ্টায় সাতবার পৃথিবীকে ঘুরে আসবে এবং এটি ফ্রান্সের সমান আয়তনের দুটি দেশকে ঢেকে দেবে। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ এক শ বছরেও পচবে না, মাটির সঙ্গে মিশবে না। দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণা, উন্নয়ন ও সংবাদ সংস্থার সঙ্গে কাজ করে থাকে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হয়।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ বিশ্বেজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন পাটের এই প্রাকৃতিক পলিব্যাগ বিশ্বের পরিবেশদূষণ কমাবে। বিশ্ববাজারে এর বিপুল চাহিদার আভাস এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসার আগেই এটি দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলেছে। ইতিমধ্যে আড়ং, স্বপ্ন, আগোরাসহ দেশীয় কয়েকটি চেইনশপ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সভা করেছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। মেগাশপগুলো এই পলিব্যাগ ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
স্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মালয়েশিয়া থেকে যন্ত্র কেনা হয়েছে। এই প্রকল্প সফল হলেই প্রতিদিন ১ লাখ পিস পলিব্যাগ উৎপাদন করা হবে।
পাট প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বায়োডিগ্রেডেবল (পচনশীল) পলিব্যাগের একটি বৈশ্বিক বাজার আছে। আমরা চাই বেসরকারি খাতও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসুক। আমাদের দেশে যে পরিমাণ পাট উৎপাদিত হয়, তার পুরোটা এই খাতে বিনিয়োগ করলেও তা বিশ্ব চাহিদার অর্ধেক পরিমাণ পূরণ করা যাবে না।’
বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, দুবাইয়ে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মাসে ২৫ হাজার পলিব্যাগ কেনার ফরমাশ দিয়েছে। শহরকে পলিথিনমুক্ত ঘোষণা করতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ এই পলিব্যাগ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও বিপুল পরিমাণে ব্যাগ কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।