Home Bangla Recent ১০% কারখানার নিয়ন্ত্রণে পোশাক খাতের ব্যবসা

১০% কারখানার নিয়ন্ত্রণে পোশাক খাতের ব্যবসা

১৯৮৪ সালে একটিমাত্র কারখানার মাধ্যমে পোশাক খাতে যাত্রা করে হা-মীম গ্রুপ। এরপর সাড়ে তিন দশকে গ্রুপটিতে যুক্ত হয়েছে আরো ২৬টি কারখানা। হা-মীম গ্রুপের এসব পোশাক কারখানায় কাজ করছেন ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক। রফতানি আয়ও বার্ষিক ৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।

নব্বইয়ের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে যাত্রা করে এ খাতের আরেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান অনন্ত গ্রুপ। এ গ্রুপের পোশাক কারখানাগুলোয় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২২ হাজার মানুষের। এর মধ্যে ১২ হাজারই কাজ করছেন আদমজী ইপিজেডে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরেও রয়েছে এ গ্রুপের কারখানা। গত পাঁচ বছরে ২৫-৩০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে গ্রুপটি।

সক্ষমতা বিবেচনায় হা-মীম ও অনন্ত গ্রুপ বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মতোই বড় কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ কারখানা। এ ১০ শতাংশ বড় কারখানাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের পোশাক খাতের ব্যবসা। হা-মীম, অনন্ত গ্রুপ ছাড়াও এ তালিকায় আছে স্কয়ার, ব্যাবিলন, এনভয়, স্ট্যান্ডার্ড, ডেকো, ইসলাম, নাসা, ইউতাহ, তুসুকা, বেক্সিমকো, এসকিউ, আরমানা, বিটপি, ডিবিএল, দিগন্ত, গিভেন্সি, ভিয়েলাটেক্স, একেএইচ ও মণ্ডল গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ১০ শতাংশ কারখানার রফতানি সক্ষমতা অনেক বেশি। বড় উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে এসব কারখানার কমপ্লায়েন্স মানদণ্ডও উন্নত। স্বাভাবিকভাবেই এসব কারখানা অন্যদের চেয়ে বেশি ক্রয়াদেশ পাচ্ছে।

পোশাক রফতানির সিংহভাগই এ ১০ শতাংশ কারখানা করছে বলে জানান এ খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানের কারখানাগুলো ভালো কাজ করায় নিয়মিত রফতানি আদেশ পাচ্ছে। পণ্যের ভালো মূল্যও পায় তারা। বড় বা ছোট বিবেচনায় সরকারের সুযোগ-সুবিধা বা নীতি ভিন্ন হয় না, নীতি সবার জন্য একই। ১০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণে নয়, বরং পুরো খাতের ৯০ শতাংশ অবদান রাখছে এ ১০ শতাংশ কারখানা। এর কোনো খারাপ দিক নেই।

বড় হিসেবে যেসব কারখানাকে ধরা হয়েছে, সেগুলোর সবারই শ্রমিক সংখ্যা তিন হাজার বা এর বেশি। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৯৯৯ শ্রমিক কাজ করছেন, দেশে এমন পোশাক কারখানা ইউনিট আছে ৮৪টি। ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৯৯৯ শ্রমিক নিয়ে চলছে ৪০টি ইউনিট। এছাড়া ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ৯৯৯ শ্রমিক কাজ করছেন এমন কারখানার সংখ্যা ২২। পাশাপাশি ৬ হাজার থেকে ৬ হাজার ৯৯৯ শ্রমিক কাজ করেন এমন কারখানা ইউনিট আছে ১৩টি, ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন এমন কারখানা ইউনিট ২৩টি এবং ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন ১৫টি পোশাক কারখানায়।

সূত্রমতে, তিন হাজারের বেশি শ্রমিক নিয়ে কার্যক্রমে থাকা কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স ভালো হওয়ায় ক্রয়াদেশও বেশি পাচ্ছে। দু-তিন হাজার শ্রমিক কাজ করেন এমন কারখানাও কম-বেশি ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। তবে কমপ্লায়েন্স মানদণ্ড বিবেচনায় ক্রয়াদেশ ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে দুই হাজারের নিচে শ্রমিক রয়েছে এমন কারখানাগুলোকে। এ ধরনের কারখানার সংখ্যাই বেশি, যা মোট কারখানার প্রায় ৮৪ শতাংশ।

বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের জার্মানিভিত্তিক অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, আন্তর্জাতিক বড় ব্র্যান্ডগুলো এখন কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় নিয়ে ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। শ্রম সক্ষমতার পাশাপাশি কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনায় যারা এগিয়ে, ক্রয়াদেশ বেশি পাচ্ছে তারাই। পরে অনানুষ্ঠানিকভাবে সাব-কন্ট্রাক্ট পদ্ধতিতে তুলনামূলক ছোট কারখানাও ক্রয়াদেশ পাচ্ছে, তবে তা সীমিত।

ক্রয়াদেশ বড় কারখানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সার্বিকভাবে রফতানি আয় কমেনি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানি বাবদ আয় ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। তখন কারখানা ছিল ৪ হাজার ২০০টি। ২০১৭ সাল শেষে পোশাক রফতানি বাবদ বাংলাদেশের আয় হয়েছে ২৯ বিলিয়ন ডলার।

সুইডেনভিত্তিক একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের আরেক প্রতিনিধি বণিক বার্তাকে বলেন, ক্রয়াদেশ আসা কমেনি বাংলাদেশে। আমাদেরটিসহ অন্য ক্রেতারা বড় গ্রুপ বিবেচনায় ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। এর কারণ হলো, একটি বড় গ্রুপের উৎপাদন ক্ষেত্র থাকে অনেক। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স যখন ছোট একটি কারখানাকে ডিসকোয়ালিফাই করে, তখন কারখানটি বিক্রি হয়ে যায়। এ কারখানাগুলোকে শ্রমিকসহ কিনে নেয় বড় গ্রুপগুলো। তারপর কিছু বিদ্যমান স্থানে সংস্কার বা অন্য স্থানে স্থানান্তর করে ক্রেতাদের দৃষ্টিতে কোয়ালিফাই করা হয় কারখানাগুলোকে। এভাবে বড় কারখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে ছোট কারখানাগুলো। আর বড় কারখানাগুলোর প্রতি এক ধরনের অন্ধ আস্থা থাকে ক্রেতাদের। এজন্য বড় সক্ষমতার কারখানাগুলো অনেক সময় উৎপাদন সামর্থ্যের অতিরিক্ত ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। সামর্থ্যের অতিরিক্ত এ ক্রয়াদেশগুলো সাব-কন্ট্রাক্ট পদ্ধতিতেই করে ছোট কারখানাগুলো।

বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলছেন, বড় কারখানা হিসেবে পরিচিত পলমল, স্কয়ার, ইপিলিয়ন, ডিভাইন, নর্দান, হা-মীমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ কেউ বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। দেশের ২৯ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের সিংহভাগই আসছে এ ধরনের ১০ শতাংশ কারখানার হাত ধরে।

আস্থার কারণেই ক্রয়াদেশের জন্য ক্রেতারা বড় কারখানা নির্বাচন করছে বলে জানান বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সক্ষমতা ও কমপ্লায়েন্স দুই বিবেচনাতেই কারখানা ভালো বিবেচিত হচ্ছে। এখানে ঠিক নিয়ন্ত্রণ বলব না, তবে ক্রেতার আস্থার কারণেই বড় কারখানাগুলো ক্রয়াদেশ বেশি পাচ্ছে। দেশে যদি তিন হাজার কারখানা থাকে, এর মধ্যে ৫০ শতাংশ বড় ব্র্যান্ডের কাজ করে। বাকিরা নন-ব্র্যান্ড বা মৌসুমি ক্রেতা কিংবা অপ্রচলিত বাজারগুলোর ক্রয়াদেশ নিয়েই সচল আছে। দেশের ২৯ বিলিয়ন ডলার আয়ের মধ্যে ১৮-২০ বিলিয়ন ডলার আয় হয় ৫০ শতাংশ কারখানার হাত ধরে। বাকি ৯ বিলিয়ন ডলার আসে অন্যান্য কারখানার হাত ধরে। বড় কারখানার বড় অংশ বা প্রভাবে সমস্যার কোনো কিছু নেই। সমস্যা তখনই হবে, যদি বড় কারখানাগুলো চায়, ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে যাক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিল্প-কারখানার উদ্যোক্তারা বলছেন, বড় গ্রুপগুলো একটি চক্র আকারে কাজ করতে চায়। নীতিগত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও এদের প্রভাব বেশি প্রতিফলিত হয়। ব্যাংকঋণ থেকে শুরু করে গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রেও বড়রাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এর বিপরীতে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ছোট কারখানাগুলো।

তবে এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বড়রা তাদের সামর্থ্য ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই এ খাতের বড় অংশ জুড়ে আছে। ভালো কারখানা ভালো করবেই। তবে ছোট কারখানাই বেশি। নিজস্ব সক্ষমতার ভিত্তিতেই বড় ও ছোটরা ব্যবসা করে যাচ্ছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তিতে বড়রা প্রভাব বিস্তার করছে, এমনটা সঠিক নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here