বাজেট পদক্ষেপ থেকে তৈরি পোশাক খাত কী সুবিধা পেল কিংবা কতটা অসুবিধায় পড়ল- তা নির্দেশ করে এ খাতের উৎসে কর। রফতানি পর্যায়ের প্রতিটি পোশাকের দর অনুযায়ী এই কর কেটে রাখা হয়। চলতি অর্থবছরে এ করহার শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ একশ’ টাকার পোশাক রফতানিতে ৭০ পয়সা কর দেন উদ্যোক্তারা। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পাস হলে উৎসে কর বর্তমানের ৭০ পয়সার সঙ্গে অতিরিক্ত ৩০ পয়সা মিলে মোট এক টাকা গুনতে হবে উদ্যেক্তাদের।
জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে উৎসে করের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে কোনো কথা বলেননি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকাল বৃহস্পতিবার তার বাজেট বক্তৃতার পর রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্নিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পোশাক খাতে উৎসে কর এক শতাংশ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘অর্থ বিলের আয় কর আইনের ৫৩বি ধারায় পোশাক খাতে উৎসে কর এক শতাংশের কথা বলা হয়েছে। বাজেটে এ বিষয়ে অন্য কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। তার মানে তা উৎসে কর আইনে উল্লেখিত এক শতাংশে ফিরে গেল। এ বিষয়ে কোনো কথা না বলা কিংবা কোনো পদক্ষেপ না থাকা উৎসে কর আইনে উল্লিখিত হারেই ফিরে যাওয়ার অর্থ বহন করে। চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবেও এই অভিন্ন নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। অবশ্য বাজেট পাসের পর উদ্যোক্তাদের জোর দাবির মুখে উৎসে কর এক শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।’
বর্ধিত হারের এই কর পোশাক খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধির আশাব্যঞ্জক ধারাবাহিকতায় ছেদ ফেলবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। তৈরি পোশাক খাতের ওপর ভর করে চলতি অর্থবছর রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হতে চলেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত গত ১১ মাসে পোশাক খাতের রফতানি এর লক্ষ্যমাত্রা থেকে তিন শতাংশ বেশি হয়েছে। আগের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এ সময়ের অন্য সব পণ্যের গড় রফতানি আয়ের তুলনায় এ হার বেশি। গড় রফতানি সাত শতাংশেরও নিচে। আয় বেড়ে চলায় মোট রফতানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান এখন ৮৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উদ্যোক্তাদের মতে, বাজেট প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কার্যকর হলে পোশাক খাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রমিক-কর্মচারীদের নতুন মজুরি ঘোষণা এবং কার্যকর হবে। দুই ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে সংস্কার ব্যয়ের সঙ্গে অনেক উদ্যোক্তাই কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। আবার বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের দর কমেই চলেছে। একদিকে বর্ধিত উৎপাদন ব্যয়. অন্যদিকে সংকোচনশীল দর পরিস্থিতি- দ্বিমুখী এ বাস্তবতায় চাপে পড়বে দেশের প্রধান রফতানি খাত।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, পোশাক খাতের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিকূল বাস্তবতার মধ্যে বর্ধিত উৎসে কর কোনোভাবেই ব্যবসা সহায়ক নয়। এ পদক্ষেপের কারণে উৎপাদন ব্যয়
আরও বেড়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কর্মসংস্থান এবং রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় এই খাত। তবে তিনি আশাবাদী- শেষ পর্যন্ত উৎসে কর কমানো হবে।
অর্থ বিলের আয়কর আইনের ৫৩ বি ধারায় পোশাক খাতে উৎসে কর এক শতাংশের কথা বলা হয়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটে এ হার দ্বিগুণ করে ৬০ শতাংশ করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে এ হার এক দশমিক ৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হলেও শেষ পর্যন্ত ৭০ পয়সায় নির্ধারণ করা হয়। একই হারেই গত দুই বছর ধরে উৎসে কর দিয়ে আসছেন উদ্যোক্তারা।
উৎসে করের বাইরে পোশাক খাত সংক্রান্ত অন্যান্য পদক্ষেপ হিসাবে প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ খাতের পাবলিক লিমিটেড বা যৌথ মূলধনি কোম্পানির কর হার সাড়ে ১২ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই চলতি অর্থবছর করের হার ছিল ১২ শতাংশ। টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশসম্মত উৎপাদনে যেসব কারখানার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গ্রিন বিল্ডিং সার্টিফিকেট রয়েছে, সেসব কারখানার জন্য এই করহার বিদ্যমান ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন তিনি। তবে এ তথ্যে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিজিএমইএ সভাপতি। সমকালকে তিনি বলেন, ‘একাধিক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী করপোরেট কর কমানোর কথা বলেছেন। সেখানে বর্তমানের তুলনায়ও বেড়ে গেল! এটা কিছুতেই হতে পারে না। বাজেট বক্তৃতায় প্রিন্টিং মিসটেক (ছাপার ভুল) হয়েছে।’ আগামীকাল এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজিএমইএ।
এবারের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এ খাতকে বিশেষ কর সুবিধা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের প্রেক্ষাপটে ২০২৭ সালের পর শুল্ক্কমুক্ত রফতানি সুবিধা না থাকার যে আশঙ্কা রয়েছে, সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান সুদৃঢ় করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
অবশ্য বাজেটে রফতানি খাতে উৎসাহ জোগাতে প্রণোদনা হিসেবে আলাদা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও এ খাতে একই পরিমাণ বরাদ্দ ছিল। তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যে প্রণোদনা খাত থেকে বিভিন্ন হারে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। চলতি বছর ২২ ধরনের পণ্যে ভর্তুকি এবং নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। রফতানিমুখী তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে দেশি বস্ত্র খাতে বিকল্প নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে চার শতাংশ। এ খাতের ক্ষুদ্র মাঝারি আকারের শিল্পের (এসএমই) জন্য প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত চার শতাংশ। এ ছাড়া নতুন পণ্য ও নতুন বাজার শ্রেণিতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ((ইইউ) ছাড়া অন্য দেশে রফতানিতে তিন শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।