Home Bangla Recent ভর্তুকিতে অভ্যস্ত বিজেএমসি!

ভর্তুকিতে অভ্যস্ত বিজেএমসি!

নানা সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ জুট মিলস্ কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি পাটকলগুলো। একদিকে বকেয়া বেতনভাতার দাবিতে রাস্তায় শ্রমিকরা, অন্যদিকে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে পাটকলগুলোতে। প্রতিবছরই তাদের কয়েকশ কোটি টাকা লোকসান বাড়ছে। অথচ একই সময়ে দেশের বেসরকারি পাটকলগুলো লাভের মুখ দেখছে।

সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, বেসরকারি পাটকলগুলো পারলে সরকারি পাটকলগুলো কেন লোকসান দিচ্ছে? চলতি বছরের ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পাটের তো কিছুই ফেলা যায় না। তাহলে পাটে লোকসান হবে কেন? বরং কিভাবে একে লাভজনক করা যায়, তা বের করতে হবে।’ বিজেএমসি সূত্র জানিয়েছে, শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে পাটকলগুলোতে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। উত্পাদন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কোনো কোনো মিলে এবছর কোনো উত্পাদন হয়নি। এ অবস্থায় সরকার ভর্তুকি না দিলে কোনোভাবেই শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি শোধ করা যাবে না। ইতিমধ্যে ভর্তুকির জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে আবেদন জানানো হয়েছে।

কিন্তু কেন এ অবস্থা? সূত্র জানিয়েছে, সরকারি পাটকলগুলোতে লোকসানের বড় কারণ কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। তারা যখন পাটের দাম কম থাকে তখন না কিনে বেশি দামে কিনে। এছাড়া তাদের কেনা পাটের গুণগত মান ভালো না হওয়া, পাটকলগুলোতে অতিরিক্ত জনবল, সক্ষমতা অনুসারে মিলের কার্যক্রম পরিচালনা না করা, সিবিএর দৌরাত্ম্যসহ আরো বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এছাড়া গত কয়েক দশকের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে পাটকলগুলো অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত উত্পাদন পাওয়া যাচ্ছে না। উত্পাদন খরচও বেশি পড়ছে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাটের বহুমুখী উত্পাদন ও ব্যবহারে দেশে ও বহির্বিশ্বে পাটের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও বিজেএমসি তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। দক্ষ জনবল ও সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে লোকসানে পতিত হচ্ছে সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। আর গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকা।

বিজেএমসির সূত্র জানিয়েছে, গত ১০ বছর সরকারি পাটকলগুলোতে লোকসানের পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এরমধ্যে ২০০৯ সালে ৩০৯ কোটি ৫৫ লাখ চার হাজার টাকা, ২০১০ সালে ২৭৫ কোটি ২৩ লাখ সাত হাজার টাকা, ২০১২ সালে ৭৮ কোটি ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা, ২০১৩ সালে ৩৯৬ কোটি ৯৭ লাখ ১২ হাজার টাকা, ২০১৪ সালে ৫১৩ কোটি ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ২০১৫ সালে ৭২৯ কোটি এক লাখ ৬১ হাজার টাকা, ২০১৬ সালে ৬৫৬ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ২০১৭ সালে ৪৮১ কোটি ৫০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা লোকসান হয়। মাঝে শুধু ২০১১ সালে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা লাভ করে বিজেএমসি। এর আগে সর্বশেষ ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা মুনাফা করে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৫০ শতাংশ উত্পাদন করে। আর কাঁচাপাট রপ্তানির ৭৮ দশমিক ৫৪ শতাংশই হয় বাংলাদেশ থেকে। অন্যদিকে ভারত ৪৯ শতাংশ কাঁচা পাট উত্পাদন করলেও তারা কাঁচাপাট রপ্তানি করে না। তারা এই পাট স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের পাশাপাশি পাটজাত পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করে। অথচ এ খাতে আমাদের লোকসান দিনদিন বাড়ছে।

চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে নিরুত্সাহিতকরণে আইন পাস করেছে। আর ২০২০ সাল থেকে সারা ইউরোপে একযোগে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। সেখানে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার হয়। এর বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশে পাটের ব্যাগের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া সরকার দেশের পাট শিল্পকে রক্ষার স্বার্থে যে বাধ্যতামূলক প্যাকেজিং আইন করছে তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এ খাতের চেহারা পাল্টে যেত।

শ্রমিকদের ৯ দফা : সরকার ঘোষিত জাতীয় মজুরি ও উত্পাদনশীলতা কমিশন-২০১৫ সুপারিশ বাস্তবায়ন, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারীদের পিএফ, গ্র্যাচুইটি ও মৃত শ্রমিকের বীমার বকেয়া প্রদান, টার্মিনেশন, বরখাস্ত শ্রমিকদের কাজে পুনঃবহাল, শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়োগ ও স্থায়ী করা, পাট মৌসুমে পাটক্রয়ের অর্থ বরাদ্দ, উত্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিলগুলোকে পর্যায়ক্রমে বি এম আরই করাসহ ৯ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সারা দেশে সরকারি পাটকলের শ্রমিকরা এ আন্দোলন করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাটকল শ্রমিকদের মজুরি বাড়ালে মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এমন অজুহাতে শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। কিন্তু ২০১৫ সালের জুলাই থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ঘোষিত পে কমিশনের মজুরি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। ফলে গত ২ এপ্রিল থেকে সারা দেশের ২৬টি পাটকলের প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ৯ দফা দাবিতে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছেন। বিজেএমসি জানিয়েছে, জাতীয় মজুরি স্কেল-২০১৫ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সব মিল কর্তৃপক্ষকে জাতীয় মজুরি স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকরা এ নির্দেশনায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না। কারণ এর আগেও বেশ কয়েকবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। পরে সে আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি।

বর্তমানে একজন শ্রমিকের মাসিক মূল মজুরি ৪ হাজার ১৫০ টাকা। ২০১৫ সালের মজুরি স্কেল বাস্তবায়িত হলে মাসিক নিম্নতম মজুরি ৮ হাজার ৩০০ টাকায় দাঁড়াবে।

এ প্রসঙ্গে বিজেএমসির চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, সাধারণ শ্রমিকদের জিম্মি করে চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা এ আন্দোলন করছেন। তারা আন্দোলনের নামে অফিসারদের উপর হামলা করছেন। এ অবস্থায় অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনের নামে সরকারকে বিব্রত করা হচ্ছে। এই আন্দোলনের ফলে পাটকলগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। তিনি বলেন, আমরা সব পাটকলে মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করতে বলেছি। কাজটি শেষ করতে দুইতিন মাস লাগবে।

বিজেএমসির চেয়ারম্যান বলেন, এ বছর অর্থ সংকটের কারণ প্রডাকশন লেভেল, মার্কেটিং লেভেলে দুর্বলতা ছিল। কোনো কোনো মিলে এ বছর কোনো প্রডাকশন নেই। বর্তমানে সিরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি দেশের খাদ্য অধিদপ্তরের কাজ করছে মিলগুলো। কিন্তু আন্দোলনের ফলে মিলগুলোতে কাজ হচ্ছে না। শ্রমিকরা নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে ঋণ ভর্তুকি চাই। ইতোমধ্যে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী আজ ( রবিবার) এ বিষয়ে ঘোষণা দেবেন। তিনি বলেন, বিজেএমসি এ ভর্তুকিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ভর্তুকি না পেলে শ্রমিকদের বকেয়া শোধ করা যাবে না।

বিজেএমসির চেয়ারম্যান বলেন, বিজেএমসিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। লোকসান ঠেকাতে পাটকলগুলো আধুনিকায়ন ও বর্ধিতকরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে মোট ৩টি পাটকল আধুনিকায়ন করা হবে। এই পাটকলগুলো হলো—নরসিংদীর ইউএমসি জুট মিলস লিঃ, যশোরের নোয়াপাড়ার যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গালফ্রা হাবিব লিঃ। এজন্য মোট ব্যয় হবে ১শ ৭৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এই অর্থের ৯০ শতাংশ দেবে সরকার। বাকি টাকা বিজেএমসির নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এছাড়া আরো ২২টি মিলও বিএম আর আই করা হবে। এ ব্যাপারে চীনের সঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে বলে তিনি জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here