কাজের অতিরিক্ত চাপে পোশাক শ্রমিকরা সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। আর এ কারণে কর্মক্ষেত্রে গড়ে ৪৩ শতাংশ শ্রমিক জখম হন। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ঘটনাই ঘটে সুই ভাঙাসংক্রান্ত। এছাড়া কেটে যাওয়া, ফুসফুসের সংক্রমণ, শরীরে অভ্যন্তরীণ আঘাত, হাত পুড়ে যাওয়া, মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার মতো সমস্যায়ও ভোগেন দেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আওয়াজ ফাউন্ডেশন ও কনসাল্টিং সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড পরিচালিত জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র সুরক্ষা থেকে শুরু করে শ্রমিকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ ও মাঠপর্যায়ে জরিপের ওপর ভিত্তি করে ‘ওয়ার্কার্স ভয়েস ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। প্রতিবেদনে ভাঙা সুইয়ে শ্রমিকদের বেশি আহত হওয়ার তথ্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে। শ্রমিকের স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নেয়া ৪২ শতাংশ শ্রমিক তাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সহনীয় বলে উল্লেখ করেছে। ১৬ শতাংশ বলেছে, শরীর দুর্বল বা বেশ দুর্বল। ৬৭ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য কাজ চালিয়ে যাওয়া ও পরিবারের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। ১৩ শতাংশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক দায়িত্ব পরিপালনে চরম সমস্যা মোকাবেলা করে। ৬৯ শতাংশ শ্রমিক তাদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির জন্য ব্যাপক কাজের চাপকে দায়ী করেছে। ২১ শতাংশ বলেছে পারিবারিক সমস্যার কথা। এক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ শ্রমিক আর্থিক বিষয়কে দায়ী করেছে। ১৪ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছে, জরিপের আগে সর্বশেষ ৩০ দিনে মারাত্মক শরীর ব্যথায় ভুগতে হয়েছে। এ সমস্যায় চরমভাবে ভুগতে হয়েছে ২ শতাংশ শ্রমিককে। জরিপের অনুসন্ধানে প্রধান মানসিক সমস্যা হিসেবে কাজের চাপ, হতাশা ও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। ৬৪ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছে, তারা কোনো না কোনোভাবে হতাশায় ভুগছে। ৪২ শতাংশ শ্রমিক কাজের চাপে হতাশার অনুভূতি ব্যক্ত করেছে। আবার নারী শ্রমিকদের ৩৯ শতাংশ পারিবারিক উদ্বেগের বিষয়টি উল্লেখ করলেও ২৫ শতাংশ আর্থিক সমস্যার কারণে হতাশ মনোভাব প্রকাশ করেছে। ৮৯ শতাংশ শ্রমিক তাদের মানসিক অশান্তির কারণ হিসেবে কাজের অতিরিক্ত চাপকে দায়ী করেছে। ৮৪ শতাংশ শ্রমিক মনে করে, বিগত বছরের তুলনায় তাদের উৎপাদন লক্ষ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের চাপে পর্যুদস্ত শ্রমিকদের মধ্যে কাজে ভুল করার প্রবণতাও বেশি বলে দেখা গেছে জরিপে। জরিপে দেখা গেছে, কাজের অতিরিক্ত চাপে শ্রমিকরা সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহারও এড়িয়ে চলেন। এক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকরা নারী শ্রমিকদের তুলনায় বেশি জখম হন। জরিপে অংশ নেয়া পুরুষ শ্রমিকদের ৪৯ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় জখম হন, এক্ষেত্রে নারীদের হার ৩৮ শতাংশ। জখমের দুই-তৃতীয়াংশ ঘটনাই সুই ভাঙাসংক্রান্ত। শ্রমিকদের আহত হওয়ার অন্যান্য ঘটনার মধ্যে আছে কেটে-ছিঁড়ে যাওয়া, ফুসফুস সংক্রমণ, শরীরে অভ্যন্তরীণ আঘাত, হাত পুড়ে যাওয়া ও মানসিক আঘাত। এ প্রসঙ্গে আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, অনেক কারখানায় পুরনো মেশিনের কারণে এ দুর্ঘটনাগুলো যেমন ঘটে, তেমনি শ্রমিকের অসচেতনতাও আছে। শ্রমিক ও মালিক দুই পক্ষের গাফিলতিতেই শ্রমিকরা জখম হন। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার ৫১ শতাংশ শ্রমিক প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কাজে অংশ নেয়। ৪১ শতাংশ শ্রমিক চিকিৎসককে দেখায় এবং ৯ শতাংশকে মেডিকেল ছুটির আবেদন করতে হয়। ২১ শতাংশ শ্রমিক অসুস্থতাজনিত ছুটি পায় না বলে উল্লেখ করেছে। ‘ওয়ার্কার্স ভয়েস ২০১৯’ প্রতিবেদন তৈরিতে শ্রমিকদের ওপর জরিপটি পরিচালিত হয়েছে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে অংশ নেন ৪৪৭ জন শ্রমিক। জরিপে অংশ নেয়া শ্রমিকদের ৭৭ শতাংশই নারী। আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, চতুর্থ ওয়ার্কার্স ভয়েস প্রতিবেদনে আমরা চেষ্টা করেছি নারী শ্রমিকের প্রতি সহিংসতা ও শ্রমিক ব্যবস্থাপনার মতো বড় বিষয়গুলোতে যে অসামঞ্জস্যতা আছে তা শনাক্ত করতে। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।