সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরিত সব ট্যানারি এখনো চালু হয়নি। পরিবেশবিষয়ক ছাড়পত্র না থাকায় বেশির ভাগ ট্যানারিতে অর্ডার কমে গেছে। এতে গত বছর সংগৃহীত চামড়ার বেশির ভাগ গুদামে পড়ে আছে। অন্যদিকে কাঁচা চামড়া কিনতে ট্যানারির মালিকদের গত বছর দেওয়া ব্যাংকঋণের অর্ধেকও পরিশোধ হয়নি। এবারে ঋণের কতটা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এসব সমস্যার সঙ্গে চামড়া পাচারের আশঙ্কাও আছে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন ঈদুল আজহায় এ দেশের ট্যানারিগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া সংগ্রহে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসাসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবেশবিষয়ক সমস্যায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের অর্ডার কমে গেছে। এতে গত বছর সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া এখনো অনেক ট্যানারিতে পড়ে আছে। ফলে এবার কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনে কোথায় রাখব? ব্যবসা ভালো না থাকায় অনেক ট্যানারি গতবার চামড়া কিনতে পাওয়া ঋণের অর্ধেকও শোধ করতে পারিনি। যে পরিমাণ ঋণ শোধ হয় তা আবারও দেওয়া হয়। তাই এবারে ঋণ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে পুরনো ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব কারণে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় এ মৌসুমে আর্থিক সংকট থাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনযায়ী কাঁচা চামড়া সংগ্রহ সম্ভব হবে না। এতে চামড়া খাতে বড় ধরনের লোকসান হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সাভারে নতুন কারখানা নির্মাণে বাড়তি বিনিয়োগে পুঁজি সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি অনেক ট্যানারির মালিক। সিইটিপিও সম্পূর্ণ চালু হয়নি।’
ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, ‘অতীতে কোরবানির ঈদের সময় ভারতের অনেক ট্যানারি বাংলাদেশ থেকে চোরাই পথে কাঁচা চামড়া কিনে নিয়ে যায়। এবারেও চামড়া পাচারে আশঙ্কা করছি। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর আবেদন করেছি।’
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে প্লটের সংখ্যা ২০৫টি, শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ১৫৫টি। চালু ট্যানারির সংখ্যা ১২৩টি। পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ৭৮টি ট্যানারিকে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সারা বছরে দেশে প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ ১৩ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয়। এর অর্ধেকই জবাই করা হয় কোরবানির ঈদের সময়। সারা দেশে কোরবানিযোগ্য প্রায় এক কোটি ১৮ লাখ গবাদি পশুর মজুদ আছে। এবার সারা দেশে কোরবানিযোগ্য ৪৫ লাখ ৮২ হাজার গরু-মহিষ, ৭২ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ছয় হাজার ৫৬৩টি অন্যান্য পশু আছে। ঈদুল আজহায় এক কোটি ১০ লাখ পশুর কোরবানি হতে পারে। গত বছর ঈদে কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর মোট সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৫ লাখ এবং কোরবানি হয়েছিল প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ।
চামড়া খাতের বিভিন্ন সংগঠন সূত্র জানায়, এ দেশের গুণগতমানের কাঁচা চামড়ার বিশ্বব্যাপী চাহিদা রয়েছে। ভারতের বামতলা, কানপুর, চেন্নাই, পাঞ্জাবে কয়েক হাজার ট্যানারি আছে। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গরু জবাইয়ে কঠোরতা আরোপ করা হয়। এবারেও তা বহাল রেখেছে। গরুনীতিতে কঠোরতা আরোপের পর ভারতের ট্যানারিগুলোতে কাঁচা চামড়ার সংকট তৈরি হতে থাকে। এ দেশে কোরবানির ঈদে অধিক পরিমাণে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সুযোগ থাকে। ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের সুবিধা পায়। তাদের চাহিদা কাজে লাগিয়ে প্রতিবছর ঈদুল আজহায় এ দেশ থেকে বিপুল চামড়া পাচার হয়ে যায়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী এ দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা আছে। আমাদের দেশে চামড়া খাতে পরিবেশগত সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ট্যানারির মালিকরা হাজারীবাগ থেকে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে সরে আসতে অনেক বেশি সময় নিয়েছে। সাভারে এসেও পরিবেশের সমস্যার সমাধান হয়নি। এতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য সরকার এবং ট্যানারির মালিক উভয় পক্ষই তাদের দায় এড়াতে পারে না।’