Home Apparel প্রতি বছর কাজ হারাচ্ছে এক লাখ পোশাককর্মী

প্রতি বছর কাজ হারাচ্ছে এক লাখ পোশাককর্মী

গত দুই দশকে দেশে তৈরী পোশাকের উৎপাদন ও রফতানি তিন গুণ বাড়লেও বাড়েনি শ্রমিকের কর্মসংস্থান। উল্টো নতুন নতুন কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর কাজ হারাচ্ছে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। বিপরীতে কর্মসংস্থান হচ্ছে এক লাখের মতো। শ্রমিকের স্থান দখল করে নিচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি। মানুষের পরিবর্তে রোবট ব্যবহারের উদ্যোগও নিচ্ছেন কোনো কোনো উদ্যোক্তা। চাকরি হারানো শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী। আর নতুন করে যাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই পুরুষ এবং প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন। স্বাভাবিক কারণেই নারীশ্রমিকের সংখ্যা ৯০ শতাংশ থেকে কমে ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর মোট শ্রমিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪৫ লাখে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতের ওপর একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত জরিপে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। আগামী এক দশকে এ খাতের মোট জনবল অর্ধেকে নেমে আসবে বলে অনুমান সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশের রফতানিবাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী তৈরী পোশাক শিল্পে ঠিক কতজন শ্রমিক কাজ করেন তারা সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই নেই। সরকারে শ্রম অধিদফতর কিংবা উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ কিংবা বিটিএমএর কাছেও এর কোনো তথ্য নেই। ভয়াবহ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিজিএমইএর পক্ষ থেকে শ্রমিকদের একটি ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলেও সে প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ঢালাওভাবে এ খাতের উদ্যোক্তাদের দাবি বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। গত প্রায় দুই দশক ধরে শ্রমিকের কর্মসংস্থানসংক্রান্ত একই দাবিতে অটল আছেন তারা। যদিও প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য গণমাধ্যমে তুলে ধরছেন বিজিএমইএ-বিকেএমইএ নেতারা।

জানা যায়, কয়েক বছর আগেও প্রতিটি কারখানায় বেশির ভাগ মেশিনে দু’জন করে শ্রমিক কাজ করতেন। একজন সুইং অপারেটর যিনি মেশিনটি চালাতেন; আরেকজন হেলপার যিনি অপারেটরের উল্টো দিকে বসে তাকে সাহায্য করতেন। গত তিন-চার বছরে বেশির ভাগ কারখানায় পর্যায়ক্রমে হেলপারের পদ খালি হয়ে গেছে। ওই জায়গা দখল করে নিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির নতুন মেশিন। পুরনো মেশিনটি বদলের সাথে সাথে চাকরি হারিয়েছে ওই মেশিনের অপারেটরও। অধিক মজুরির অপারেটরকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মজুরির হেলপারকে দিয়েই করানো হচ্ছে নতুন মেশিনের অপারেটরের কাজ। একটি মাঝারি মাপের কারখানার কাটিং বিভাগে আগে ১৫০ থেকে ২০০ কর্মীর দরকার হতো। সেখানে এখন অটোমেটিক কাটার মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কাজ চালানো যাচ্ছে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক দিয়ে।

কাজ হারানো শ্রমিকের বেশির ভাগই নারী কর্মী দাবি করে শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার নয়া দিগন্তকে বলেন, একটা সময় ছিল যখন সুতা কাটা, আয়রন করা, কাটিং, ড্রয়িং এমন বেশির ভাগ কাজই মেয়েরা করত। এসব জায়গায় বর্তমানে আধুনিক মানের মেশিন এসেছে। বিভিন্ন ধরনের মেশিন চলে আসায় আগের মতো আর শ্রমিকের দরকার হচ্ছে না। বাদ পড়াদের বেশির ভাগই নারীশ্রমিক দাবি করে নাজমা বলেন, নারী কর্মীরা দামি মেশিন চালাতে পারবে না বলেই বেশির ভাগ মালিকের ধারণা। ফলে বাদ দেয়ার সময় নারী কর্মীদেরই সবার আগে বাদ দেয়া হয়। তিনি বলেন, আগে একটা কারখানায় ৫০০ লোক কাজ করলে এখন লাগে ১০০ জন। আগে যেখানে ৯০ শতাংশ নারীশ্রমিক ছিল সেখানে এখন ৫০ শতাংশ মেয়েও নেই বলে দাবি করেন এই শ্রমিকনেত্রী।

দাবির সত্যতা মেলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা থেকেও। সংস্থাটির ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে এলে তখন আর বিনা শুল্কের সুবিধা পাবে না। তখন তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদনের সক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাভাবিক কারণেই কারখানা মালিকেরা প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন। সময়ের চাহিদার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে এ দেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতেও পরিবর্তন আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই শ্রমিক-জায়গাগুলো ধীরে ধীরে মেশিনের দখলে চলে যাচ্ছে। পরিবর্তন আসছে মেশিনেও। আগে যেসব মেশিন আমদানি করা হতো, এখন আমদানি করা হচ্ছে তারচেয়ে অনেক উন্নত মানের এবং দামি মেশিন। উদ্যোক্তাদের মাইন্ডসেটের কারণে এ খাতে শ্রমিকের কর্মসংস্থান দিন দিন কমছে। সবচেয়ে বেশি কমছে নারীকর্মীর সংখ্যা।

গার্মেন্ট মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে চারজন লোক যে কাজ করত এখন এক মেশিন সে কাজ করে। একজন শ্রমিককে কমপক্ষে আট হাজার টাকা মজুরি দিতে হয়। চারজন শ্রমিকের পেছনে যায় ৩২ হাজার টাকা; কিন্তু এখন আট হাজার টাকায় একজন লোক রেখেই একটি মেশিন চালানো যায়। ব্যাংকের কাছে চাইলে মেশিনের টাকা ঋণ পাওয়া যায়। কাজেই মালিকেরা সেই পথেই যাচ্ছেন। এর ধাক্কাটা সবচেয়ে বেশি পড়ছে নারী কর্মীদের ওপরই। কারণ প্রথাগতভাবে এ শিল্পে নারী কর্মীর সংখ্যা বেশি। ঘন ঘন শ্রমিক অসন্তোষ এবং কম উৎপাদনশীলতার কারণে উদ্যোক্তারা আধুনিক প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক নয়া দিগন্তকে বলেন, শ্রমিকেরাই এ দেশের তৈরী পোশাক শিল্পের প্রাণ। আমরা শ্রমিকদের ওপরই নির্ভরশীল। তবে কাজের উপযুক্ত পরিবশে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে শ্রমিক, মালিক এবং সরকার; সব পক্ষেরই দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পোশাক শিল্প খাতে শ্রমিকের কর্মসংস্থান কমছে জানিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো: ফজলুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় নতুন উদ্যোক্তা আসছেন না। ফলে অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি কারখানা অটোমেশনের কারণেও শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটা মাঝারি আকারের কারখানার কাটিং সেকশনে ১৫০ থেকে ২০০ জন লোক লাগত। সেখানে এখন অটোমেটিক কাটিং মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে শ্রমিক লাগে দশ থেকে বারোজন। অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ লোক লাগে। এ রকম অটোমেশন কিন্তু চলছেই। আগামী দশ বছরে এই শিল্পে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অটোমেশনের কারণে যত লোক কাজ হারাচ্ছেন, তাদের আবার এই শিল্পেই কোনো না কোনোভাবে কর্মসংস্থান হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here