দেশের প্রধান শিল্প খাতগুলোয় দক্ষ জনবলের সংকট তীব্র হচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ৯টি শিল্প খাতে ৮০ লাখ দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত।
এ সুযোগে পোশাক খাতে কয়েক হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেশে নিয়ে যাচ্ছেন এসব বিদেশি শ্রমিক। অন্যদিকে বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি জনশক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এ বিপুল মানুষের মাধ্যমে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আসার কথা, তা আসছে না। এর অন্যতম কারণ প্রবাসে বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তির অভাব।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে বিভিন্ন খাতে মোট ৮ কোটি ৮৭ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে। এই সময় পর্যন্ত দেশের ৯টি শিল্প খাতে নিয়োগ দিতে হবে আরও ১ কোটি ৬৬ লাখ ৮৪ হাজার নতুন শ্রমিক। তাদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক লাগবে ৮০ লাখ, আধা দক্ষ ৫৬ লাখ, অদক্ষ শ্রমিক লাগবে ৩১ লাখ।
৮০ লাখ দক্ষ শ্রমিকের জোগান নিশ্চিত করতে হলে আগামী পাঁচ বছরে ৫৬ লাখ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষিত বেকাররা প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে বেকারত্ব যেমন ঘুচবে, ঘটবে অর্থনৈতিক উন্নয়নও। তা না হলে উভয় সংকটে ভুগবে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে শ্রমিক ঘাটতি প্রকট হচ্ছে। শিল্পকারখানায় এখন অসংখ্য পদ খালি। দেশে শিক্ষিত বেকারের অভাব নেই। তবে অভাব রয়েছে দক্ষ শ্রমশক্তির।
দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হচ্ছে না বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর। দক্ষ কাজের লোক পাচ্ছেন না কারখানার মালিকরা। অগণিত কর্মক্ষম মানুষ বেকার থাকার পরও শ্রমিকের অভাবের জন্য দক্ষতার অভাবকে দায়ী করছেন শিল্পমালিকরা। আগামী বছরগুলোয় শিল্পের প্রয়োজন মেটাতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক কেএএস মুর্শীদ বলেন, বর্তমানে দক্ষ শ্রমিকের অভাব বড় আকার ধারণ করেছে। ভবিষ্যতে এটা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। আগামী ১০ বছরে তৈরি পোশাক খাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব হতে পারে অন্তত ১৫ লাখ। এ প্রকট বাড়তে থাকলে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। তাই সরকারকে দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে বেশি গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বিআইডিএসের ‘বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও দক্ষতার ঘাটতি’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ঝোঁক বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা গড়ে উঠছে না। আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছে, তার সঙ্গে শিল্প খাতের চাহিদার কোনো সামঞ্জস্য নেই।
আর উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কোনো একটি কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া বা ডিপ্লোমা সম্পন্ন করার আগ্রহ থাকে না। ফলে শিল্প খাতে এসব উচ্চশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক হিসেবেও নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন। ফলে শিল্প খাতে শিক্ষিত শ্রমিকের সংকট রয়েছে। তবে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর যারা বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার খুবই কম।
দেশের বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের বড় ৯টি খাত হচ্ছে- তৈরি পোশাক ও বস্ত্র, নির্মাণ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, হেলথ কেয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন ও আতিথেয়তা, চামড়া, হালকা প্রকৌশল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প। এসব খাতে কর্মরতদের ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশেরই কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
বিআইডিএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ জোগানদাতা দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি প্রকট থেকে প্রকটতর হবে। তখন এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা দাঁড়াবে ৫০ লাখ ২৭ হাজার ৪৬৩ জন। আর দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি দাঁড়াবে অন্তত ১৫ লাখ। বর্তমানে এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৪৭৯ জন।
আর আধা দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে ৪৮ হাজার ১৩০ জন। এছাড়া অদক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে ৮ হাজার ৫৭৭ জন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জোর দিচ্ছেন তিনটি বিষয়ের ওপর। এগুলো হল শিক্ষিত তরুণদের উপযোগী শোভন কাজের সুযোগ সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আয় বাড়ানো এবং চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করা।