Home Apparel সঙ্কটে গার্মেন্টস শিল্প

সঙ্কটে গার্মেন্টস শিল্প

গ্রামীণ জনপদে ‘অর্থনৈতিক বিপ্লব’ ঘটে গেছে। মঙ্গা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের রংপুরে এখন মঙ্গা ‘শব্দ’ উঠে গেছে। কার্তিক-চৈত্র মাসে খাদ্যাভাবে যে সব মানুষকে ‘উপোষ’ থাকতে হতো; তারা এখন হাজার হাজার, লাখ লাখ টাকার মালিক।

পল্লী কবির ‘আসমানী’র ঘর যাদের ছিল ঠিকানা; তারা এখন টিনের ঘর-সেমি পাকা ঘরে বাস করছেন। সারাদেশের পল্লীগ্রামের মানুষের এই যে পরিবর্তন; তার নেপথ্যে রয়েছে গার্মেন্টস শিল্প। কিন্তু নানান ষড়যন্ত্র এই শিল্পকে ধ্বংস করার চক্রান্ত হচ্ছে; চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাটের মতো গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত রুখে দিতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। জানতে চাইলে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি করা গার্মেন্টটির পরিচালক গোলাম মোস্তফা ইনকিলাবকে বলেন, গত ৬ থেকে ৮ মাস ধরে তাদের ক্রেতা সঙ্কট চলছে। কাজ আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমে গেছে। তাই বাধ্য হয়েই ছাঁটাই করতে হয়েছে।

সূত্র মতে, গ্রামের মেয়ে এবং অশিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত তরুণ-যুবকরা গার্মেন্টসে কাজ করে টানাপোড়েনের সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ফেরানোর পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির ভীত শক্ত করছেন। প্রবাসী শ্রমিকদের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স আসছে তার অন্যতম খাত হলো গার্মেন্টস শিল্প। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের তৈরি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক অর্থ আয় করছে। দুনিয়াব্যাপী অস্থিরতার মধ্যেও যে তৈরি পোশাক রফতানিতে দেশ সাফল্যের শিখরে সেই গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংসের চেষ্টা করছে একটি চক্র। যে কারণে সঙ্কটে পড়ে ব্যয় সঙ্কোচন বা লোকসান থেকে বাঁচতে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি বা গার্মেন্টস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা।

এদিকে কাজের পরিবেশ নিরাপদ করার জন্য শ্রমিক নিরাপত্তা বাড়াতে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স প্রতিনিয়ত চাপ দিলেও তারা পোশাকের দাম বৃদ্ধি করছেন না। উপরন্তু পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যহারে কমছে। পাশাপাশি রয়েছে অনিশ্চিত গ্যাস সরবরাহ, বাজারে অস্থিরতা ও পণ্যের দামের আচমকা উঠা-নামার মতো সমস্যা। আর এসব কারণে পোশাকখাতে প্রতিদিনই বাড়ছে অস্থিরতা। বিদেশি ক্রেতাদের চাপে কারাখানা নিরাপদ করতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করলেও তৈরি পোশাকের দাম না বাড়ায় মালিকরা আছেন বিপাকে। আর তাই প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গার্মেন্টস বন্ধ করে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা এবং শ্রমিক চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। যা দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিখাত গার্মেন্টস সেক্টরকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এছাড়া স¤প্রতি সরকারের নেয়া গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে চাপে ফেলবে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ। অপরদিকে অগ্নি নিরাপত্তা ইস্যুতে চার শতাধিক পোশাক কারখানাকে সতর্ক করে নোটিশ পাঠিয়েছে ইউরোপের ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সঙ্গে শর্ত ভঙ্গ করে ওইসব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ পাঠানোয় তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে দেশের পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ঢাকার গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানা যেখানে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করে। নাম প্রকাশ না করে কারখানার মালিক বলছিলেন, কাজের পরিবেশ নিরাপদ করার জন্য এই কারখানায় প্রায় সাত কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর বিদেশি ক্রেতাদের চাপে পড়ে তিনি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। পাশাপাশি সেটি পুষিয়ে নেবার জন্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্যও বিনিয়োগ করেছেন। ফলে পোশাক রপ্তানির অর্ডার পাবার জন্য কারখানা গুলোর মধ্যেও চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলাদেশেই যদি আরেকটি প্রতিষ্ঠান কম অফার করে, তাহলে বায়াররা (ক্রেতারা) কেন স্বপ্রণোদিত হয়ে দাম বাড়াতে যাবে? তাই বেতন-বোনাসসহ নানা কারণে বিপাকে পড়তে হচ্ছে গার্মেন্টস মালিকদের। আর মালিকরাও যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটি মনে করেন না শ্রমিক পক্ষ। যা শঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করছে। অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, অনিশ্চিত গ্যাস সরবরাহ, বাজারে অস্থিরতা ও পণ্যের দামের আচমকা উঠা-নামার মতো সমস্যার কারণেই নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে ইচ্ছুক নন। এর মধ্যে আচমকা গত জুলাই মাসে গ্রাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং সম্প্রতি অ্যাকর্ডের অগ্নি নিরাপত্তা ইস্যুতে চার শতাধিক পোশাক কারখানাকে সতর্ক করে নোটিশ পাঠানো গার্মেন্টস মালিকদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ভেস্তে দেবে। নানামুখী সঙ্কটের মধ্যে সম্প্রতি সরকারের নেয়া গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত তৈরি পোশাক শিল্পকে চাপে ফেলবে বলে মনে করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি ভবিষ্যতে গার্মেন্টস কারখানার হাজার হাজার কর্মী চাকরি হারাবেন।

এদিকে একসঙ্গে ৭০০ শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করেছে ঢাকার তেজগাঁওয়ের এসএফ ডেনিম অ্যাপারেলস লিমিটেড। সঙ্কটে পড়ে ব্যয় সঙ্কোচনের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি এটা করা হয়েছে শ্রমিক ইউনিয়ন করার উদ্যোগ নেয়ার কারণে। সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএমের মতো বিশ্বের নামি কয়েকটি ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক সরবরাহকারী এসএফ ডেনিম নিজেদের ‘সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্ট’ কারখানা বলে দাবি করে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটির পাঁচটি ইউনিটে প্রতি মাসে ১০ লাখ পোশাক তৈরি করতে সক্ষম বলে তাদের ওয়েবসাইটে বলা আছে। কোম্পানির ওয়েবসাইটে শ্রমিকের সংখ্যা দেয়া আছে ৬ হাজার ৯০০ জন। ঈদের পর আকস্মিক চাকরিচ্যুতির নোটিসে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন গার্মেন্টসে এভাবে চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে।

বিষয়টি নিয়ে গার্মেন্টটির পরিচালক গোলাম মোস্তফা ইনকিলাবকে বলেন, গত ৬ থেকে ৮ মাস ধরে তাদের ক্রেতা সঙ্কট চলছে। কাজ আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমে গেছে। তাই নিরুপায় হয়েই সকল সুবিধা দিয়েই শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছি। শ্রমিকরাও বিষযটি জেনেছেন। তারাও মেনে নিয়েছেন। তবে গোলাম মোস্তফা আশা করছেন, বিজিএমই প্রেসিডেন্টসহ সংশ্লিষ্টরা বিদেশি ক্রেতাদের এখান থেকে আরও বেশি পোশাক ক্রয়ের ব্যাপারে উৎসাহী করতে কাজ করছেন। তাই শিগগিরই এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর অন্যতম পরিচালক আসিফ ইব্রাহীম বলেন, মালিকদের পক্ষ থেকে আমরাই কথা বলছি। কারখানাটি সম্পূর্ণ আইন মেনে যথাযোগ্য নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করেছে।

শ্রমিক চাকরিচ্যুতির কারণ ব্যাখ্যা করে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক সাংবাদিকদের বলেন, গত ছয় মাস ধরে ক্রেতা সঙ্কটের কারণে কারখানাটি শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সক্ষমতার ৫০ শতাংশ ক্রয় আদেশও তারা পায়নি। কারখানাটি সচল করার ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদের আরও বেশি পোশাক কেনার আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেছেন, এসএফ ডেনিমের মালিক পক্ষ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ৭০০ শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করেছে।
২০১৮ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গার্মেন্টস খাতের চলমান অস্থিরতা বজায় থাকলে এ লক্ষ্যমাত্রা অসাধ্য বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে পোশাক শিল্পের সম্পূরক দেশীয় সুতা ও কাপড়ের বস্ত্রশিল্প এখন প্রায় ধ্বংসের পথে। বন্ড সুবিধায় আনা বিদেশি সুতা-কাপড়ের কালোবাজারি বন্ধ না হওয়ায় স্থানীয় মিলের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ছোট-বড় চার শতাধিক স্পিনিং মিলে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে ৮ লাখ টনের বেশি সুতা। কাপড়ের মিলগুলোর অবস্থাও একই রকম। এতে মাসের পর মাস লোকসান গুনতে গিয়ে ছোট মিলগুলোতে তালা ঝুলতে শুরু করেছে। বড় মিলগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। উপরন্তু, পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিদেশ থেকে সুতা ও কাপড় আমদানির নামে এলসি মূল্য বাড়িয়ে চলছে নির্বিঘ্নে অর্থ পাচার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় বস্ত্র খাত আর বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। আগামী ৬ মাসের মধ্যে বেশিরভাগ মিল বন্ধ হয়ে যাবে। যদি মিলগুলো বাঁচাতে হয় তাহলে বাংলাদেশে উৎপাদিত সুতার সমমানের বিদেশি সুতা এক বছরের জন্য আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে।

একইসঙ্গে নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ দিতে হবে। এ অর্থ দ্রুত প্রদানের ক্ষেত্রে সব বাধা দূর করতে হবে। পাশাপাশি যেসব উদ্যোক্তা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তাদের ঋণ পরিশোধে যৌক্তিক সময়ও দিতে হবে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বস্ত্র খাতের সমস্যা নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলে বহু দেন-দরবার করেছি। চিঠি দিয়েছি কয়েক দফায়। কিন্তু লাভ হচ্ছে না।

আসলে সরকার এখন শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে মনোযোগী। কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এর সুফলভোগী। সব ক্ষেত্রেই তারা সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকে অবদান রাখা বস্ত্র খাত নিয়ে কেউ ভাবছে না। তিনি বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই বস্ত্র খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি সুতার দাম আড়াই ডলার। যদিও এ দরে বিক্রি করেও অনেকে খরচ তুলতে পারছেন না। অপরদিকে বন্ড সুবিধায় আনা ভারতীয় সুতা বিক্রি হয় ২ ডলার ৩০ সেন্টে। বাস্তবে এসব সুতা আনতে এলসি খোলা হয় ৩ ডলারের বেশি।

সূত্র মতে, অনেক গার্মেন্টস আছে যেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও সেগুলোর নামে বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা-কাপড় আমদানি করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয় তাহলে বস্ত্রশিল্প বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। পাশাপাশি দেশে নতুন শিল্প গড়ে উঠবে না।

হাজী আবুল হাশেম স্পিনিং মিলের স্বত্বাধিকারী এসএম সোলায়মান জানান, বেশি দামে আমদানিকৃত তুলা দিয়ে সুতা ও কাপড় তৈরি করে মিল মালিকরা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন।
তিনি বলেন, এভাবে মাসের পর মাস লোকসান দিয়ে এবং ব্যাংকের ঋণ ও সুদ গুনতে গিয়েই সব কিছু বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর তাই পাট শিল্প যেমন ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে, তেমনি এখনই উদ্যোগ নেয়া না হলে বস্ত্র খাতের পরিণতিও সেদিকে যাবে।

এ সঙ্কট নিরসনে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বিদেশি সুতা ও বস্ত্রের বাজারে পরিণত হবে দেশ। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হবে, যা বস্ত্র খাতের জন্য বড় অশনিসঙ্কেত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here