লাগাতার আন্দোলনের মুখে গত বছর পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু এই মজুরি বৃদ্ধির পরও শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি হয়নি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, দুই বেলা খাবার নিশ্চিত এবং ঘর ভাড়া দিতে গিয়ে একজন শ্রমিক প্রতিদিন দুই থেকে চার ঘণ্টা ওভারটাইম করেও জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারখানাগুলো এখন দক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি না করে উল্টো কম মজুরি দিয়ে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে। আর খরচ কমাতে সিনিয়র কর্মীদের ছাঁটাই করছে। নতুন মজুরিকাঠামো অনুযায়ী বর্তমানে একজন শ্রমিক কাজে যোগদানের শুরুতে পাবেন ৮ হাজার ৩০০ টাকা (প্রায় ৯৭ ইউএস ডলার)। এর আগে শ্রমিকরা পেতেন ৫ হাজার ৩০০ টাকা। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের বর্তমান ন্যূনতম মজুরি বিশ্বে সবচেয়ে কম। যদিও পোশাকশ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছিলেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালাগের (সিপিডি) এক গবেষণা বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের জীবন পরিচালনার খরচ শতকরা ৮৬ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে শুধু খাদ্যমূল্যই বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৫৭ ভাগ।
আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নয়জনই নিজের এবং তার পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাবার কিনে খেতে পারেন না। কিছু সময় তারা উপোস থাকেন এবং ঋণ করে সংসার চালান। শতকরা ৭২ শতাংশ শ্রমিক জানান, তারা নিজের চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে পারেন না। প্রতি তিনজন শ্রমিকের একজন অপর্যাপ্ত আয়ের জন্য সন্তান থেকে আলাদা থাকেন। তানিয়া নামের এক পোশাকশ্রমিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, অল্প মজুরি পাওয়ার কারণে তাকে তার একমাত্র সন্তানকে গ্রামে মা-বাবার কাছে রেখে আসতে হয়েছে এবং বছরের মাত্র দুই ঈদে তানিয়া তার সন্তানকে দেখার সুযোগ পান। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাড়ি ভাড়া, খাবার, পোশাক কেনা ও চিকিৎসা বাবদ পাঁচজনের একটি পরিবারের খরচ বর্তমান ন্যূনতম মজুরি মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, মালিকরা তাদের মোট আয়ের মাত্র ১২ শতাংশ শ্রমিকদের বেতন-ভাতায় ব্যয় করেন। ঢাকার রামপুরার পোশাকশ্রমিক নাদিরা বেগম (২৬) বস্তির ছোট একটি কক্ষে ৩ হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন। নাদিরার সঙ্গে থাকে তার চার বছরের সন্তান। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় নাদিরার সঙ্গে সব সময় থাকেন না। বাজারে পণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাসের খরচ চালাতে নাদিরাকে হিমশিম খেতে হয়। এজন্য প্রতি মাসের শেষে তাকে টাকা ধার করে চলতে হয়। সামজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একজন শ্রমিকের সুস্থতা, বিশ্রাম, খাবার, চিকিৎসা ব্যয় ইত্যাদি নির্ভর করে তার মজুরির ওপর। একজন শ্রমিকের কাছ থেকে তার মালিক যে পরিমাণ কাজ আদায় করে নিতে চান, এজন্য সেই শ্রমিকের পর্যাপ্ত খাবারসহ বিশ্রামের প্রয়োজন। আর এজন্য একজন শ্রমিকের মজুরি ১৮ হাজার টাকা প্রয়োজন। আগামী বছর বাড়ি ভাড়া ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। দ্র্ব্যমূল্যের বাজারও অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। আর একজন শ্রমিক যদি ভালোভাবে খাবার ও প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না পান তবে তিনি অসুস্থ হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়বেন। তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুস সালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করেই শ্রমিকদের সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরিকাঠামো চালু করেছি। গত পাঁচ মাসে পোশাক রপ্তানি খাতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের বর্তমান মজুরিকাঠামোয় বেতন দেওয়ার সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও আমরা চলতি বছর ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করেছি।’ এর বাইরেও পোশাকশ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে। কেউ আবার মধ্যরাত পর্যন্ত (রাত ৩টা) কাজ শেষ করে পরদিন আবার সকাল সাড়ে ৭টায় কাজ শুরু করেন। শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার কথা। কিন্তু মালিকরা উৎপাদনের টার্গেট পূরণ করতে শ্রমিকদের দিয়ে অতিরিক্ত কয়েক ঘণ্টা জোর করে কাজ করাতে বাধ্য করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শ্রমিকরা সকাল ৮টায় এসে কারখানা থেকে রাত ৮টা বা ১০টার পর বের হন। অর্থাৎ গড়ে শ্রমিকরা ১০ ঘণ্টার মতো সময় ব্যয় করেন। রোজিনা নামের মিরপুরের এক পোশাকশ্রমিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার বেতন ৮ হাজার টাকা। কিন্তু বাড়তি রোজগারের জন্য তাকে ওভারটাইম করতে হয়। এজন্য তাকে প্রায়ই মাথাব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা ও পিঠব্যথায় ভুগতে হয়। এর বাইরে পোশাকশ্রমিকদের অধিকাংশেরই কোনো সঞ্চয় নেই। এ ছাড়া অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার কারণে শ্রমিকদের প্রায়ই অগ্নিকান্ডের মতো বড় দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। শ্রমিকরা জানান, পোশাক কারখানার যে ফ্লোরগুলোয় কাজ করেন তারা, সেখানে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত শ্রমিক কাজ করেন। আর তৈরি পোশাক থেকে সৃষ্ট ধুলাবালির কারণে তাদের শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। বৈদ্যুতিক পাখা থাকলেও তা অপর্যাপ্ত। এই ফ্লোরগুলোয় কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র নেই। এতে গ্রীষ্মকালে অপর্যাপ্ত পাখার জন্য শ্রমিকরা অতিরিক্ত গরমে হাঁসফাঁস করেন। গরমে সহকর্মীদের ঘামের দুর্গন্ধে এবং একটি বড় কক্ষে একসঙ্গে কয়েক শ সেলাই মেশিনের উচ্চ শব্দের কারণে শ্রমিকরা প্রায়ই অসুস্থ বোধ করেন।
এর বাইরে কক্ষগুলোর স্বল্প আলো, প্রতিদিন সুউচ্চ ভবনে পায়ে হেঁটে ওঠার কারণে শ্রমিকদের বেশ ভোগান্তি হয়।