Home Recent করোনায় বিপর্যস্ত ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্যসহ গোটা অর্থনীতি

করোনায় বিপর্যস্ত ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্যসহ গোটা অর্থনীতি

করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবে স্মরণকালের ভয়াবহ ধস নেমেছে দেশের ঈদকেন্দ্রিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যসহ গোটা অর্থনীতিতে। যদিও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে লকডাউন কিছুটা শিথিল করেছে সরকার, কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। ঈদ ঘিরে প্রতিবছর দেশে লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। এবারে সেই বিশাল অংকে ভাটা পড়বে।

শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপের ফলে দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত রেমিট্যান্সও পর্যুদস্ত। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী। অনেকেই এরই মাঝে শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন।

অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমান ঈদ বাজারের অবস্থা অন্য বারগুলোর মতো নয়। সীমিত পরিসরে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও জমেনি ঈদ বাজার। অধিকাংশ দোকানপাট-শপিংমলই বন্ধ। যে কয়টি খুলেছে করোনা আতঙ্কে সেগুলোতেও ক্রেতা সমাগম সেভাবে নেই। বেচাবিক্রি না থাকায় হতাশ বিক্রেতারা।

করোনা পরিস্থিতিতে ৩০ মে পর্যন্ত দেশে সাধারণ ছুটি বহাল থাকবে। দীর্ঘ এ ছুটিতে সবকিছু বন্ধ থাকায় বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সম্প্রতি তার একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের একদল গবেষক।

তাদের মতে, সাধারণ ছুটিতে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে গড়ে মোট অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ দিনে কমপক্ষে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৩১ দিনের অবরুদ্ধ অবস্থায় অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মে মাস শেষে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের মোট দেশীয় উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, এবারের ঈদ হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য নিরাশার। এ বছর ঈদে লাখ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, যারা ঈদকেন্দ্রীক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যদিও সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে অল্প সংখ্যক দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে খুবই সীমিত পর্যায়ে। এই মুহূর্তে ঈদ উৎযাপনে কেনাকাটার মানসিকতা নেই মানুষের। ফলে এবছর ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি বহুলাংশে থমকে গেছে। ঈদ ঘিরে ইতোমধ্যে যে বিনিয়োগ হয়েছে তাও উঠে আসবে না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপণী বিতানগুলো। এরপর রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে গেছে। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক বছর লেগে যাবে।

‘সব চেয়ে বেশি আঘাত এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। ব্যাবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি বেশি হবে শহর এলাকায়। আর এ বাস্তবতায় সব চেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। যারা ক্ষুদ্র কোনো কাজ করতেন, যেমন কাজের বুয়া, রিকশাচালক, ছোট ছোট কারখানার কর্মী, মুদি দোকানের কর্মী, টেইলার্সের কর্মী, বিক্রয়কর্মী- এরকম লোকজন। কাজ না থাকায় তারা ঢাকা থেকে গ্রামে চলে গেছেন। তাদের আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সরকার যে লাখ টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে সেটা ভালো। তবে এ মুহূর্তে সেটা তেমন প্রয়োজন ছিল না। আরো দুই মাস পর প্রয়োজন হবে। এখন দেখার বিষয় সরকার কীভাবে এ প্যাকেজ বাস্তবায়ন করে।’   

গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ঈদ ঘিরে অর্থনীতি ব্যবস্থাকে সচল করতে গিয়ে আমরা স্বাস্থ্যখাতকে কতটা ঝুঁকিতে ফেললাম সেটা আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে বোঝা যাবে। বর্তমানে প্রতিদিন নতুন করে হাজারও মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, এ অবস্থায় আমরা ঈদকে কেন্দ্র করে দোকানপাট খুলে একটা বড় ঝুঁকি নিয়েছি। এ বছর ঈদ স্বাভাবিক হবে না। 

‘এ বছর ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা বা অর্থনীতির ক্ষতি কী পরিমাণ হবে সেটা এ মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে ব্যবসায়ীরা বলেন, তাদের সারা বছরের অর্ধেক ব্যবসাই হয়ে থাকে এই ঈদে। সেটা এ বছর হবে না। অর্থনীতিতে ক্ষতি হলে গ্রাম ও শহর সবখানেই তার প্রভাব পড়ে। শহরের ব্যবসায়ী, শ্রমিকরা আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত, গ্রামের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, হস্ত ও কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত, ফলে ক্ষতিটা সবারই হবে। আমদানি-রফতানি, পোশাক শিল্প, পর্যটন, রেমিট্যান্স সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি।’

ড. নাজনীন বলেন, সরকার প্রায় লাখ টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার একটা ফান্ড দিয়েছে, সেখান থেকে নিঃশর্তে একটা অংশ একেবারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য দিতে হবে আগামী তিন মাস। যাতে করে তারা চলতে পারে। পাশাপাশি করোনার পর তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যও পরিকল্পনা করতে হবে। 

উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, এবার ঈদ কেন্দ্রিক কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনীতি নেই। শুধু বাঁচার তাগিদে অর্থনীতি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, তিনি আমাদের দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছেন। এতে করে ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত বেঁচে থাকবে। 

‘করোনা ভাইরাসে জীবন যেখানে বিপন্ন, সেখানে ব্যবসার ক্ষতি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা বাংলাদেশে ১০ শতাংশ মার্কেট খুলেছে। তাও স্বাস্থ্য বিধি না মানায় তার মধ্যেও অনেক দোকান পাট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, ফলে কী ব্যবসা হবে? আগেই আমরা বলেছি, দেশে ৫৬ লাখ ব্যবসায়ী, ২৬ মার্চের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের প্রতিদিন ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি।’

করোনা পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স খাতের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, এপ্রিল মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। গত বছরের এপ্রিলে এর পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সে তুলনায় এবার এপ্রিলে রেমিট্যান্স আহরণ প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের মার্চেও দেশে রেমিট্যান্স আসে ১২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে তা ১৫.৬২ শতাংশ কমেছে।

বৈশ্বিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার সরকারি প্রাক্কলনের অর্ধেকেরও বেশি কমে ২-৩ শতাংশের মধ্যে নেমে যেতে পারে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ অর্থবছর তা ৮.২ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জিডিপির আকার ছিল ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ৩ শতাংশ জিডিপি কমলে অর্থবছর শেষে জিডিপি এক লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা কম হবে। জিডিপি আরও বেশি কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

এদিকে বিজিএমইএ’র দেওয়া তথ্যমতে, পোশাক খাতে গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২০ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু পোশাক খাতেই ক্ষতি হবে ৪২ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। করোনা সংক্রমণ তীব্র হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। বর্তমানে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ। শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বে কিনা সে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে শ্রমিকদের বেতন দিতে, তারপরও এখন রপ্তানিমুখী শিল্পের ৪০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে কারখানা সচল হওয়ার ওপর।

করোনার কারণে লকডাউনে সড়ক, নৌপথে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও বন্ধ। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, এতে করে সড়কপথে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার মতো। এ হিসেবে গত এক মাসে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপবিল্ডার্স ইন্ডাস্ট্রিজের দাবি, এরই মাঝে নৌখাতে ক্ষতি হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে।

এছাড়া বিশ্বব্যাপী যোগাযোগহীনতায় পর্যটনশিল্পও ভয়াবহ হুমকির মুখে। বর্তমানে একেবারেই বন্ধ এ খাত। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সভাপতি রাফেউজ্জামান জানান, পর্যটন শিল্পে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি এ খাতের অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী এখন বেকার। অচলাবস্থার কারণে জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, বিমান সংস্থা, পর্যটক পরিবহন ও গাইডিং সংশ্লিষ্টরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here