কোনো প্রণোদনাতেই তৈরি পোশাক খাতের কর্মী ছাঁটাই থামছে না। বিভিন্ন কৌশলে ছাঁটাই করা হচ্ছে কারখানায়। তাই করোনার এই সময়ে তিন শঙ্কায় দিন কাটছে শ্রমিকদের—জীবনের শঙ্কা, চাকরির শঙ্কা এবং চাকরিতে টিকে থাকলেও মজুরি পাওয়ার শঙ্কা। কর্মচ্যুতির ঘটনায় সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে এবং শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভও দানা বাঁধছে। শ্রমিক বিক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। করোনার ভীতিকর এই পরিস্থিতিতে কর্মহীন শ্রমিকদের কেউ অন্য কোনো কাজেও নিচ্ছে না।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, যেকোনোভাবে পোশাক খাত টিকিয়ে রাখতে হবে। অন্যথায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। পোশাক কারখানার সঙ্গে প্রচুর সংযোগ শিল্প জড়িত। এসব শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কর্মসংস্থান এবং বাজার অর্থনীতিতে ধস নামবে। তাই সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদেরও মানবিক হতে বলছেন বিশ্লেষকরা।
করোনার প্রভাবে ধস নেমেছে দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাক খাত। বিশ্ববাজারে ৩১৮ কোটি ডলারের বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছে ক্রেতারা। ফলে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকা এবং ৩৫ বিলিয়নের মতো রপ্তানি আয় নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত তৈরি পোশাক শিল্পে আয় কমেছে ১৯ শতাংশ।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজেটের প্রণোদনা রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে। সারা বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারিতে টালমাটাল, জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক এমন এক অভূতপূর্ব সংকটের মধ্যে সরকার দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাতকে সংকট মোকাবেলায় সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৈরি পোশাক খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় বাজার। আর পোশাকই ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় নিয়ে আসে। করোনায় প্রথম ধাক্কায় ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়ায় পোশাক রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে ৫৪ শতাংশের মতো; যদিও সংকটের একেবারে শুরুতেই পোশাক শ্রমিকদের তিন মাসের মজুরি দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল দিয়েছিল সরকার। তার পরও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। ঈদের পর সেটি নতুন করে বেড়েছে। অন্যদিকে ৪২০টি কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে।
ভারতভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়াজির অ্যাডভাইজরস এক গবেষণায় বলেছে, করোনায় বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের চাহিদা ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সেটি কমতে পারে ৪০ শতাংশ আর জাপানে ২০ শতাংশ। এতে চলতি বছর তিনটি দেশ ১২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি কমিয়ে দিতে পারে।
সরকারের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কভিড-১৯-এর সংকট থেকে দেশের রপ্তানি খাতকে পুনরুদ্ধারে সরকার বাজেটের আগে-পরে অনেক সুবিধা দিয়েছে। এ ছাড়া আগের অনেক সুবিধা অব্যাহত রেখেছে। এর পরও রপ্তানি খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ চাহিদার সংকট। সে জন্য দুটি কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস করা। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ক্রেতা দেশগুলো যখন স্বাভাবিক হয়ে যাবে তখন যদি আমরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকি, তবে পণ্য সরবরাহ করা যাবে না। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। না হলে তারা টিকতে পারবে না।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) সূত্র জানায়, করোনার এই সময়ে এরই মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার খবর তাদের কাছে রয়েছে। অবশ্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। ছাঁটাইয়ের এই ধারা আগামী কয়েক মাস অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিল্প পুলিশের এক নিজস্ব প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের পরবর্তী ছয় মাস অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় এক হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১০ লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারাবেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পোশাক খাতে নানা কৌশলে কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে। কাউকে জোর করে মাতৃত্বকালীন ছুটি, সাধারণ ছুটির সময় বাড়ি যাওয়া শ্রমিকরা ফেরার পর নানা অজুহাতে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যাঁদের কাজের বয়স এক বছর হয়নি এবং যাঁদের বয়স একটু বেশি হয়েছে তাঁদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। করোনার এই সময়ে দেশের চার হাজারের বেশি কারখানার ৭০ শতাংশ কারখানায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। অথচ শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে এরই মধ্যে সরকারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আদায় করে নিয়েছে মালিকপক্ষ।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন কালের কণ্ঠকে বলেন, নানা প্রণোদনার পরও শ্রমিক ছাঁটাই চলায় সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে বিক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হবে। সরকারের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এ সময় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মালিকরা শ্রমিকদের বেকারত্বের ঝুঁকির কথা তুলে ধরে সরকারের কাছ থেকে আরো বেশি ফায়দা আদায় করার চেষ্টা করবেন। সারা দেশেই ছাঁটাই চলছে উল্লেখ করে রতন বলেন, এর ফলে সামাজিক দায় নিতে হবে সরকারকে। মালিকরা সরকারের এত প্রণোদনা পেয়েও ব্যবসা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই ভাবছেন না।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের পোশাক খাতের শ্রমিকরা বর্তমানে তিন শঙ্কায় আছেন। জীবনের শঙ্কা, চাকরির শঙ্কা, এবং মজুরির শঙ্কায়। তিনি বলেন, করোনার সময়ে এরই মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। প্রণোদনার টাকা নিয়েও গত ১ জুন ইউন্ডি গ্রুপের তিনটি কারখানা থেকে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। অথচ সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুসারে যেসব কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করবে, তারা প্রণোদনার টাকা পাবে না।
সাভার-আশুলিয়ায় থেমে নেই শ্রমিক ছাঁটাই : ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের হিসাবে এ পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, মামলা প্রত্যাহার, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল, বকেয়া পাওনা পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকরা এরই মধ্যে কয়েক দফায় সাভার ও আশুলিয়ায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। তবে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তালিকাভুক্ত কোনো পোশাক কারখানা বন্ধ হয়নি বলে জানিয়েছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। ২৫ থেকে ৩০ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে সাবকন্ট্রাক্টে পরিচালিত বেশির ভাগ পোশাক কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বলে দাবি শ্রমিক নেতাদের।
এদিকে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের ৪৬১ কারখানায় এখনো শ্রমিকদের মে মাসের বেতন দেওয়া হয়নি। এসব কারখানার বেশির ভাগই আয়তনে ছোট এবং সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করে। বেতন না পেয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন লক্ষাধিক শ্রমিক।
জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী শিল্পাঞ্চলের বিসিক এলাকার নাইটিঙ্গেল, পারিজাত এলাকার মিজহু করপোরেশন ও কোনাবাড়ী এলাকার মাস্টার পিট কারখানায় এখনো বেতন হয়নি। টঙ্গী, বোর্ডবাজার, ভোগড়া, কোনাবাড়ী ও কাশিমপুর শিল্প এলাকায় এ ধরনের কয়েক শ কারখানার লক্ষাধিক শ্রমিকের মে মাসের বেতন হয়নি।