Home বাংলা নিউজ সংকটাপন্ন পোশাক খাত টিকিয়ে রাখতে নীতিসহায়তা চান উদ্যোক্তারা

সংকটাপন্ন পোশাক খাত টিকিয়ে রাখতে নীতিসহায়তা চান উদ্যোক্তারা

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সরাসরি আঘাত হেনেছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। একের পর এক বাতিল হয়েছে ক্রয়াদেশ। কাজ না থাকায় বন্ধ হচ্ছে অনেক পোশাক কারখানা। যেসব প্রতিষ্ঠান চালু আছে সেখানে কাজ অর্ধেকে নেমে এসছে। এসব কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে রফতানি। এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমঘন শিল্প খাতকে সচল রাখতে আসন্ন বাজেটে রফতানিতে বিশেষ নীতিসহায়তা চান পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সময়কালে পোশাক খাতের বৈশ্বিক ক্রেতারা ৩১৮ কোটি ডলারের পণ্যের রফতানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৩০ কোটি টাকা (বিনিময় হার ৮৫ টাকা ধরে)। এক হাজার ১৫০টি কারখানায় এসব রফতানি আদেশ বাতিল বাতিল হয়েছে, যেখানে প্রায় ২৩ লাখ শ্রমিক কাজ করেন।

পোশাক খাতের এমন কঠিন সংকটময় অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের কাছে বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছে এ খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।

বিজিএমইএ বলছে, করোনা আক্রান্ত বিশ্ব বাজারে সৃষ্ট অভূতপূর্ব সংকটে তৈরি পোশাক খাত আজ হুমকির সম্মুখীন। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের মার্কেট শেয়ার ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তত ৪০ শতাংশ সংকুচিত হয়ে আসবে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার, যা অকল্পনীয় দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই মানব সভ্যতার শত বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক সাহসী সিদ্ধান্ত বলে মনে করে বিজিএমইএ।

পোশাক খাতকে কঠিন সংকট থেকে বের করে আনতে আগামী বাজেটে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জাগো নিউজকে জানান বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক। এর মধ্যে রয়েছে আসন্ন বাজেটে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ এবং আমদানি কাঁচামাল ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্য রফতানিতে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তার প্রত্যাশা করছে সংগঠনটি। চলতি অর্থবছরে এই দুই ধরনের পণ্য রফতানিতে যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ নগদ সহায়তা রয়েছে। মোট পোশাক রফতানিতে দেশি কাঁচামালে উৎপাদিত পণ্যের অবদান প্রায় ৫৫ শতাংশ। বিশ্ব মন্দার বাজারে টিকে থাকার জন্য এ নগদ সহায়তা বাড়ানোর দাবি পোশাক মালিকদের।

বিজিএমইএ বাজেট প্রস্তাবে রফতানি সংশ্লিষ্ট স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত সব পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফসহ রিটার্ন দাখিল করা হতে অব্যাহতি চেয়েছে। এছাড়া পূর্বের অব্যাহতি প্রাপ্ত সেবাসমূহের ক্ষেত্রে বকেয়া ভ্যাট দাবি না করা এবং পোশাকশিল্পের আয়কর ও শুল্ক সংক্রান্ত চলমান সুবিধা বহাল রাখার দাবি করেছে সংগঠনটি।

চলমান বিশ্ববাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন বাজার তৈরি ও পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো এবং রফতানি প্রতিযোগী দেশগুলো সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাজেটে বেশকিছু নীতিসহায়তাও চায় বিজিএমইএ।

ভার্চুয়াল মার্কেট প্লেস

ভার্চুয়াল মার্কেট প্লেসের মাধ্যমে ক্রেতাদের বাতিল করা রফতানি আদেশ, যা কারখানায় তৈরি পণ্য বা কাঁচামাল অবস্থায় পড়ে আছে সেগুলোকে অনলাইনের মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়ের সুযোগ দেয়া। এজন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সংক্রান্ত রফতানি ব্যবসাবান্ধব বিশেষ নীতিমালা করা। অ্যামাজন, আলিবাবার মতো একটি বিশেষ সার্টিফায়েড সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে কাজ করতে বিজিএমইএকে অনুমতি প্রদান।

আগামীতে ভার্চুয়াল মার্কেট তৈরির ওপর জোর দিতে হবে জানিয়ে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘এখন পুরো বিশ্ব অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় করছে। অনলাইনে ব্যবসায়ী টু ভোক্তা (বিটুসি) মার্কেটে এগোতে হবে। এতে করে ক্রেতাজোটের দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে না। পাশাপাশি পণ্য উৎপাদনের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য সরকারের প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা জরুরি।’

প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে বিশেষ সহায়তা

চলমান পরিস্থিতিতে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে ডলারপ্রতি অতিরিক্ত পাঁচ টাকা বিনিময় হার দেয়া, বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা, পরিষেবা বিলের ভর্তুকি মূল্য নির্ধারণ করা, রাজধানী থেকে কারখানাগুলোকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) স্থানান্তরিত করলে বিশেষ কর অবকাশ সুবিধা দেয়া এবং উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে বাজারগুলোতে (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল) রফতানির ওপর বিশেষ নীতিসহায়তা দেয়া।

পণ্য বহুমুখীকরণে বিশেষ সহায়তা

বিশ্ব চাহিদা অনুযায়ী নতুন পণ্য বহুমুখীকরণ এখন খুবই জরুরি। এজন্য মৌলিক পণ্যের বাইরে নতুন ক্যাটাগরিতে পোশাক উৎপাদন এবং কারিগরি উৎকর্ষতা উৎসাহিত করার জন্য পাঁচ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রদান করা দরকার। এক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্যে যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য পাঁচ বৎসর মেয়াদি কর অবকাশ প্রদান করা এবং নিজস্ব ডিজাইন ও ব্র্যান্ডের পণ্য রফতানি করার জন্য ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা চায় বিজিএমইএ।

এছাড়া শিল্পখাত বহুমুখীকরণে কারিগরি ও অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তাদের বিশেষ সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া। এজন্য বিশেষ উৎসাহ ও ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা ১০ বছরের জন্য প্রদান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থানান্তর এবং নতুন ভবন নির্মাণ বাবদ বিশেষ ঋণসুবিধা প্রদান, ১৫ বছর মেয়াদি এবং বাণিজ্যিক সুদহারের অর্ধেক (সুদহারের ওপর ৫০% ভর্তুকি) হারে প্রদান করা।

এক্সিট পলিসি তৈরি করা

করোনার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রুগ্ণ ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কারখানাসহ যেকোনো সময় উদ্যোক্তারা ব্যবসা থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে তাদের জন্য এক্সিট পলিসি তৈরি করা। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের দাবি করেছে বিজিএমইএ।

পোশাক শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন

সরকারের সোশ্যাল সেফটি নেট প্রকল্পের আওতায় পোশাক শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের পুষ্টি, বাসস্থান, যাতায়াত ও শিক্ষাখাতের জন্য ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ চায় বিজিএমইএ ।

ভ্যাট সংক্রান্ত নীতিমালা

রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক দ্রব্য ও সার্ভিসের ক্রয়কৃত মূল্যের ওপর ভ্যাট সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার এবং প্রতিমাসে রিটার্ন দাখিলের বিধান রহিত করে উদ্যোক্তাদের হয়রানি থেকে মুক্তি দেয়া। সোর্স ট্যাক্স আগামী পাঁচ বছরের জন্য ০.২৫% হারে নির্ধারণ করা এবং নগদ সহায়তার ওপর পাঁচ শতাংশ কর প্রত্যাহারের পাশাপশি এইচএস কোড সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার দাবি করেছেন বিজিএমইএর এই শীর্ষ নেতা।

এদিকে সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে করোনাভাইরাস সংকট পোশাক খাতে কতটা প্রভাব ফেলেছে, সেই চিত্র তুলে ধরে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘বিজিএমইএর নিবন্ধিত কারখানা ছিল দুই হাজার ২৭৪টি, তার মধ্যে এখন এক হাজার ৯২৬টি চলছে। অর্থাৎ বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। করোনার বিশ্বের ভোক্তার চাহিদা কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা বলছে, আগামীতে ৬৫ শতাংশ ভোগ চাহিদা কমে যাবে। তাই পোশাকের চাহিদা বাড়ার তেমন সম্ভাবনা কম।’

তিনি বলেন, দেশের পোশাক কারখানায়ও ৫৫ শতাংশ (চাহিদা) কমে যাবে। ৪২ হাজার কোটি টাকা মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ক্ষতি হবে। করোনায় দেশের ৯৯ শতাংশ পোশাক কারখানা ৫৫ শতাংশ ক্যাপাসিটি দিয়ে চালাতে হবে। জুনে কারখানাগুলোতে ৩০ শতাংশ কাজ হবে। জুলাইয়ে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। আমাদের বড় ধাক্কা খেতে হবে। এটি অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ সহায়তা ছাড়া এ খাতকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে জানান বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here