সংকটে থাকা তৈরি পোশাক খাত নগদ প্রণোদনার ওপর ভর করে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনার কারণে টানা পাঁচ মাস বহুমাত্রিক ক্ষতি হয়েছে পোশাক খাতে। কারখানা পরিচালন ব্যয়ের চাপে উদ্যোক্তারা ছিলেন দিশেহারা। আরো ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও করেন অনেকেই। এমন পরিস্থিতিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় সরকার। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পোশাক খাতের অনুকূলে দুই দফায় ৮ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয় সরকার। পাশাপাশি শিল্প খাতে চলতি মূলধনের জন্য সরকারের যে ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ আছে তা থেকেও প্রয়োজনীয় ঋণ নিয়ে সংকট সামাল দিতে পারবেন পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা। মূলত এই প্রণোদনার বদৌলতেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে পোশাক খাত। পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা এমন তথ্য জানিয়েছেন। উদ্যোক্তারা জানান, করোনার কারণে আন্তর্জাতিক চাহিদাও অনেক কমে। নতুন রপ্তানি আদেশ শূন্যের কোটায় নেমে আসে। পুরনো ক্রয়াদেশও বাতিল হয়। আবার রপ্তানিকৃত পণ্যের প্রস্তাবিত দামও কাঁটছাঁট হয়। এভাবে চাহিদা হ্রাস ও পণ্যের দাম পতনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধির বাধ্যবাধকতার কারণে কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতার ৫৫ শতাংশই ব্যবহার করতে পারেনি। এসবের প্রভাবে উদ্যোক্তার হাতে নগদ অর্থের সরবরাহ শূন্যের কোটায় নেমে এলেও বেতন পরিশোধ করতে হয়েছে বসে থাকা শ্রমিকদের। এখন প্রণোদনার কল্যাণে খাতটি ঘুরে দাঁড়ালেও আগামীর অগ্রগতি নির্ভর করছে ক্রেতা- চাহিদার উন্নতির ওপর। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দাপ্তরিক তথ্য অনুযায়ী, করোনার ধাক্কায় তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক চাহিদা ৪৫-৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ৯৮ কোটি ২০ লাখ ইউনিট পোশাকের পুরনো ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ৩১৮ কোটি মার্কিন ডলার। ফলে চাকরি হারানো ঝুঁকিতে পড়েন ২৩ লাখ পোশাক শ্রমিক। তবে উদ্যোক্তাদের অনেকের দাবি, এ তথ্য শুধু লেনদেনভিত্তিক বিজিএমইএর অফিসিয়াল ভাষ্য। প্রকৃতপক্ষে, করোনায় পোশাক খাতে ক্ষতি আরো বেশি হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ, এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে যে আয় হয়েছে তা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক খাতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় কমেছে ১ হাজার ২৫ কোটি ডলার। যা শতকরা ২৬ দশমিক ৮৩ ভাগ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এর তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় কমেছে ৬১৮ কোটি ডলার। টাকার অংকে এর পরিমাণ ৫২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এতে আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছর পোশাকখাতে মাসওয়ারি অর্জন বিবেচনায়ও কমেছে আয়। এতে দেখা গেছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছর মার্চে ২০.১৪, এপ্রিলে ৮৫.২৫, মে মাসে ৬২.০৬ এবং জুনে ১১.৪৩ শতাংশ আয় কমেছে। পোশাক রপ্তানি কমার এমন ভয়াবহতা আগে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘করোনায় চাহিদা এবং রপ্তানি কমে যাওয়ায় পোশাক খাতে নগদ অর্থের সরবরাহ ভয়াবহ রকম কমেছিল। এতে একটা সংকটাপন্ন পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছিল পোশাক খাত। সে অবস্থা থেকে পোশাক খাত এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।‘ তিনি জানান, করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্যাকেজের একাংশ পোশাক খাতের জন্য দ্রুত ছাড় করা হয়। পোশাক খাতে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি দিতে ওই প্রণোদনা তহবিল থেকে দুই দফায় ঋণ ছাড় করা হয়। প্রথম দফায় মাত্র ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকা খাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের অনুকূলে ছাড় করা হয়। এর মাধ্যমে চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুনের মাসে কারখানা পরিচালন ব্যয় বাবদ মজুরি পরিশোধ করেছেন তারা। দ্বিতীয় দফায়ও পোশাক খাতে অর্থের সরবরাহ আরো বাড়াতে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধন বাবদ ইতোপূর্বে ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাইতেও সরকার সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ ভর্তুকি বহন করে আরো ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়। তৈরি পোশাক শিল্প মালিক দের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘করোনার আঘাত মানুষের জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতিই বদলে দিয়েছে। ভোক্তার চাহিদা এবং ভোগ প্রবণতা ৪৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটা অঘোষিত স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে পোশাকের ক্রেতারাও অস্বাভাবিক আচরণ করছে। চাহিদা কমায় উৎপাদনও কমাতে হয়েছে ৪৫-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু কারখানার পরিচালন খরচ থেমে থাকেনি। অন্যদিকে, পণ্য বিক্রি না হওয়ায় এবং ব্যাংক থেকে উদ্যোক্তারা তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে ঋণ না পাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছিল পোশাক খাতে। এখন আমরা সেই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।’