করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশের উদ্যোক্তারা। অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলা এসএমই খাত সরকারঘোষিত প্রণোদনার টাকা পেতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে। সরকারঘোষিত প্রণোদনার টাকা পেতে পদে পদে হয়রানি হতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। তৈরি পোশাক খাত প্রণোদনা টাকা যতটা সহজে পেয়েছে, এসএমই খাতের জন্য সেই টাকা পেতে ততটা কঠিন। এসএমই খাতের প্রণোদনার টাকা বিতরণে গঠিত ১১ সদস্য কমিটির বৈঠকেও ব্যাংকগুলোর অনীহা অসন্তোষ প্রকাশ করেন কমিটির সদস্যরা। একই সঙ্গে প্রণোদনার টাকা দ্রুত ছাড় করার তাগিদ দেন তাঁরা।
করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে একটি জরিপ করেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। সরকারি সংস্থাটি বলেছে, করোনায় এই খাতে দুই মাসে ক্ষতি হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মনজুর হোসেনের গবেষণায় দেখা গেছে, সুদ পরিশোধ ছাড়াই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এই ৯২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বিআইডিএসের জরিপ বলছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য প্রণোদনার টাকা পেতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করে টাকা পাওয়া অনেক কঠিন। কারণ, মাত্র ৩৮ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। বাকি ৬২ শতাংশ উদ্যোক্তা কখনো ব্যাংকে যাননি। ৪৯ শতাংশ উদ্যোক্তার এনজিও থেকে ঋণ নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। বাকি ৫১ শতাংশেরই এনজিও থেকে ঋণ নেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই।
মনজুর হোসেন বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাগজপত্র নেই। তাই তাঁদের ঋণের টাকা পাওয়া কঠিন। বিআইডিএস বলছে, মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এসএমই খাত থেকে। শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশই এই খাতে, যা সংখ্যায় প্রায় এক কোটি। এই খাত মাসে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উত্পাদন করে, মজুরি দেয় প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ‘দেশে ১৫ জনের কম কর্মচারী থাকা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৩ লাখ ৭২ হাজার, যা মোট প্রতিষ্ঠানের ৩৯ শতাংশ। এসব প্রতিষ্ঠানে ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৯২৯ জন কর্মী কাজ করেন।’
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ৬০ লাখ এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছেন। পরিসংখ্যান মতে, দেশের মোট ৯০ শতাংশ শিল্প ইউনিট এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত। সেই সঙ্গে শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত মোট শ্রমিকের ৮৭ শতাংশ এবং মোট সংযোজিত পণ্যের ৩৩ শতাংশ এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত। এসএমই খাতে তুলনামূলক স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান হচ্ছে ২৫ শতাংশ। আর সামগ্রিকভাবে শিল্প খাতে এসএমইর অবদান ৩২ শতাংশ।
শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশই হচ্ছে এসএমই খাতে। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে সবচেয়ে বিপর্যস্ত এসএমই খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির সভাপতি মির্জা নূরুল গনি শোভন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রণোদনার টাকা ছাড় এত কম হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। ২০ হাজার কোটি টাকার ছাড়ের বিষয়ে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো শিথিল করা জরুরি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনার টাকা কারা পাচ্ছে, তা নজরদারি করারও তাগিদ দেন তিনি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা যত সহজে প্রণোদনার তহবিল পেয়েছেন, এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি ততটা সহজ হচ্ছে না। এই খাতের ঋণ পেতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, এসব শর্ত প্রতিপালন করে ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। অনেক উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা কখনো ব্যাংকের পথ মাড়াননি। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ব্যাংকের মাধ্যমে না দিয়ে সরকারি সংস্থা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে বিতরণের তাগিদ দিয়ে আসছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়া আরো সহজ করতে হবে। এই খাতের দিকে সরকারের আরো বেশি করে নজর দেওয়া উচিত।