সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেমেও করোনাভাইরাসের পাদুর্ভাবে বিদায়ী বছরের পুরোটাতেই দেশের তৈরি পোশাক খাত ছিল টালমাটাল অবস্থায়। বছরেরই শুরুতে বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম খাত তৈরি পোশাক নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার খবর আসতে থাকে।
প্রায় তিনশ কোটি ডলারেরও বেশি ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়। এপ্রিলে পোশাক রফতানি থেকে আয় তলানিতে ঠেকে। পরের মাসগুলোতে ধীরে ধীরে রফতানি বাড়লেও করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সেই আশার আলোটুকু কেড়ে নেয়। শুধু তাই নয়, বছর শেষে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থান হারাতে পারে এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বাতিল হতে থাকে অর্ডার : মার্চ থেকেই পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ (অর্ডার) বাতিল হতে থাকে। একইসঙ্গে স্থগিত হতে থাকে ক্রয়াদেশ। দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ার অগেই পোশাক খাতে মহাসংকটের শঙ্কা দেখা দেয়। মধ্য মার্চ থেকেই অর্ডার বাতিল হওয়ার খবর আসতে থাকে। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত করোনার প্রভাবে পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত তিনশ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরে অবশ্য আবার কিছু কিছু অর্ডার ফিরতে থাকে। বাতিল হওয়া কাজও শুরু হয়। তবে প্রায় পুরো বছরজুড়েই পোশাক রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তৈরি পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ২৮৯ কোটি ৪৫ লাখ (১২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন) ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম। আর এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩ দশমিক ১১ শতাংশ কম। সুত্র বলছে, ২০২০ সালের মার্চে ২২৫ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক পণ্য রফতানি হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। আর এপ্রিলে রফতানি আয় গিয়ে ঠেকে প্রায় তলানিতে। মাসটিতে ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮৫ শতাংশ কম। তারপরও পোশাক রফতানি আগের বছরের চেয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। জুন মাসে এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতংশের মতো।
লুকোচুরি খেলা : করোনাভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব অফিস-আদালতে ছুটি ঘোষণা করা হলেও পোশাক কারখানার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়নি সরকার। তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ অধিকাংশ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে অনেক শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান। তবে সরকার আবারও ছুটি বাড়ালেও পোশাক মালিকরা কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসেননি। অনেক কারখানাই চালু ছিল। চাকরি বাঁচাতে শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে ঢাকায় ফিরতে থাকেন। বহু সংখ্যক শ্রমিকের বারবার বাড়ি আসা যাওয়ার কারণে করোনার সংক্রম বাড়তে থাকার শঙ্কার বিষয়টি সামনে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র পোশাক মালিকদের সমালোচনায় ঝড় উঠে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে পরে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি থাকলেও এপ্রিলের শেষভাগেই লুকোচুরির মধ্যে বেশিরভাগ কারখানা খুলে যায়। তখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম চলছিল।
দ্বিতীয় ঢেউয়ে শঙ্কা : ইউরোপসহ বহির্বিশ্বে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের গার্মেন্টস শিল্পে পড়েছে বলে পোশাক মালিকরা বলে আসছেন। তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে কোনো কোনো ক্রেতা উৎপাদন শুরু না হওয়া ক্রয়াদেশ আপাতত স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। আবার কিছু ক্রেতা তাদের আউটলেট বা দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য মেইলে জানিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় একটি বায়ার প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে তাদের অফিস থেকে দেড়শ কর্মী ছাঁটাই করেছে বলে জানা গেছে।
প্রণোদনা : করোনার প্রভাব বিবেচনায় রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা করা হয়। সেই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিয়ে এপ্রিল-জুনে ৩৫ লাখ পোশাক কর্মীকে ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে বেতন দেওয়া হয়। শর্ত ছিল এ ঋণ ১৮ মাসে পরিশোধ করতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউর প্রসঙ্গে তুলে ধরে বিজিএমইএ এ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে বাড়িয়ে ৫ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ৬ মাস থেকে বাড়িয়ে ১২ মাস করার প্রস্তাব দিয়েছে।