Home বাংলা নিউজ টিকে থাকার লড়াই করছে দেশের পোশাক কারখানাগুলো

টিকে থাকার লড়াই করছে দেশের পোশাক কারখানাগুলো

তৈরি পোশাকের ব্রিটিশ খুচরা বিক্রেতা প্রাইমার্ক জানায়, তাদের গুদামঘরে এখন ১৫ কোটি পাউন্ড মূল্যের পোশাক মজুদ রয়েছে, যা ২০২০ সালের বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে কেনা হয়েছিল। ইউরোপ ও আমেরিকার তৈরি রিটেইল ব্র্যান্ডগুলোর কাছে জমেছে অবিক্রীত পোশাকের বিপুল মজুদ। বাড়তি পণ্য কমাতে তারা বসন্তকালীন পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। সরবরাহ উৎসেও করা হচ্ছে দেরিতে মূল্য পরিশোধ। এই চাপে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ আরএমজি রপ্তানিকারক বাংলাদেশের কারখানাগুলো। ২০২০ সালের বিপর্যয়ের বৃত্ত থেকে এখনও বের হতে পারেনি বৈশ্বিক পোশাক শিল্প। বিশেষ করে, রপ্তানি উৎস ধনী দেশগুলোতে নতুন করে লকডাউন সামগ্রিক উত্তরণের আশার আলো নিভিয়ে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, প্রভাব ফেলছে উৎপাদন কেন্দ্র উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় টিকাদানের যেনতেন অবস্থা। আবার, বিদেশি কিছু বড় রিটেইলার ব্র্যান্ডের কাছে এখনও আছে গেল বছরে আমদানি করা পোশাকের চালান। স্বাভাবিক সময়ে, এত দীর্ঘসময় পুরোনো পণ্যের মজুদ তাদের কাছে থাকে না। কিন্তু, মহামারিতে বেচা-বিক্রির শোচনীয় হাল এবং লকডাউন পরিস্থিতি বিপরীত দশা সৃষ্টি করে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তৈরি পোশাকের ব্রিটিশ খুচরা বিক্রেতা- প্রাইমার্ক জানায়, তাদের গুদামঘরে এখন ১৫ কোটি পাউন্ড মূল্যের পোশাক মজুদ রয়েছে, যা ২০২০ সালের বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে কেনা হয়েছিল। আর একই বছরের শীতকালে কেনা ২০ কোটি পাউন্ড মূল্যের মজুদ রয়েছে। আর্থিক পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিন্সে বলছে, সঠিক সময়ে বিক্রি না হওয়ার ফলেই দেখা দিয়েছে এ পণ্যজট। বিশ্বব্যাপী বিপণীকেন্দ্র ও গুদামঘরে ১৪০ থেকে ১৬০ কোটি ইউরো মূল্যের পোশাক অবিক্রীত থাকার কথা জানায় তারা, যা স্বাভাবিক সময়ের চাইতে দ্বিগুণেরও বেশি। ব্রিটেনের মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার ও জার্মানির হিউগো বস – চলতি বছরের বসন্তে তুলনামুলক ছোট আকারের ক্রয়াদেশ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। অ্যাপারেল ব্র্যান্ডগুলোর পুঁজিবাজার পরামর্শক সংস্থা- সাক্স ফিফথ এভিন্যিউ- এর সাবেক প্রেসিডেন্ট রন ফ্রাস্ক বলেন, রিটেইলাররা এখন খুব ছোট আকারে অর্ডার দিচ্ছে এবং ডেলিভারির সময়সীমাও সংক্ষিপ্ত করে এনেছে। “বেশিরভাগ ব্র্যান্ড এখন জাহাজে করে পণ্য পোঁছানোর সময়ে যাতে দেরি না হয়- সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চালানের অন্যান্য ব্যাপারেও দেখানো হচ্ছে অনমনীয় মনোভাব। বিশেষ করে, কেনার সময় প্রায় সকলেই রক্ষণশীল আচরণ করছে। আমার জানা মতে, অনেকে চালান প্রাপ্তির পর মূল্য পরিশোধেও দেরি করছে।” বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে হংকং- ভিত্তিক সোর্সিং এজেন্ট লি অ্যান্ড ফুং। তারা ৫০টি দেশের ১০ হাজার কারখানা থেকে বিশ্বের নামী-দামি রিটেইলার ব্র্যান্ডের জন্য পোশাকের চালান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। সংস্থাটি রয়টার্সকে জানায়, কিছু রিটেইলার তাদেরকে দেরিতে মূল্য পরিশোধের শর্ত ক্রয়চুক্তিতে রাখার জন্য অনুরোধ করেছে। তবে লি অ্যান্ড ফুং গ্রাহক অনুরোধের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশে অসম্মতি জানায়।

কারখানা পর্যায়ে শোচনীয় হাল:

আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের এই সিদ্ধান্তে অশেষ দুর্গতি ও যন্ত্রণায় পড়েছে কারখানা পর্যায়। বিশেষত, বাংলাদেশের মতো বস্ত্র রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির উৎপাদকদের রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার দশা। ফ্যাক্টরি চালু রাখতে তাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হচ্ছে। দেশের তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সংস্থা (বিজিএমইএ) ৫০টি কারখানার উপর এক সমীক্ষা চালায়। জরিপে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে তারা স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম অর্ডার পেয়েছে। বড়দিনের আগে ইউরোপ জুড়ে লকডাউন এবং তারপর জানুয়ারিতে আরেকদফা জনজীবন নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিমালা তাদের ব্যবসায় কঠিন হানে, বলেই জানায় কারাখানাগুলোর কর্তৃপক্ষ। ‘সাধারণত তিন মাস আগে ক্রয়াদেশ আসে। কিন্তু, এখনও মার্চের জন্য কোনো অর্ডার পাইনি,’ বলছিলেন ঢাকা-ভিত্তিক কারখানা মালিক শহিদুল্লাহ আজিম। তার কারখানায় উৎপাদিত সিংহভাগ পোশাকের ক্রেতা উ. আমেরিকা এবং ইউরোপের রিটেইলাররা। আজিম আরও বলেন, “আমরা এখন সক্ষমতার ২৫ শতাংশে কাজ করছি। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার মতো কিছু অর্ডার পেয়েছি। তারপর ভবিষ্যতে কি হবে-তা আমার জানা নেই। কীভাবে টিকে থাকব বা আদৌ টিকতে পারব কিনা- তাও জানি না।” এশিয়ার তৈরি পোশাক উৎপাদক ছয়টি দেশের জোট স্টার অ্যালায়েন্স। জোটের মুখপাত্র মিরান আলি বাংলাদেশে চারটি কারখানার মালিক। তিনি একই প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন,”এই সময় মার্চ পর্যন্ত কার্যাদেশ পেয়ে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা পূর্ণ থাকার কথা। স্বাভাবিক সময়ে আমরা শীত ও বসন্তের এই সময়ে বেশ ভালো ব্যবসা করি। কিন্তু, সবমিলিয়ে অর্ডারের গতি নেই, আসলেও আসছে বেশ ধীর গতিতে।” আসিফ আশরাফ নামে ঢাকার আরেক কারখানা মালিক প্রতিকূল অবস্থায় খুব কষ্টে টিকে থাকতে হচ্ছে বলে জানান। “আমরা ফ্যাব্রিক তৈরি করে, সেলাইয়ের কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এই সময় হঠাৎ রিটেইলাররা অর্ডার স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়।”

উন্নত বিশ্বের হাল-হকিকত:

টেক্সটাইল রিসাইক্লিং সংস্থা পার্কার লেন গ্রুপ রয়টার্সকে জানায়, সংক্রমণ পরিস্থিতিতে উন্নতি না হওয়ায় আসন্ন গ্রীষ্ম পর্যন্ত বন্ধ থাকতে পারে বিপণীকেন্দ্র। তার আগেই নিজেদের পুরোনো মজুদ বিক্রি করতে চায় রিটেইল ব্র্যান্ডগুলো। পার্কার লেনের মুখ্য নির্বাহী র‍্যাফি কাসাদজিয়ান জানান, প্রতি মাসে তারা গড়ে ১৫ লাখ পিস অ্যাপারেল পণ্য প্রক্রিয়াজাত করতেন, জানুয়ারি নাগাদ সেই সংখ্যা ৪০ লাখ পিসে উন্নীত হয়েছে। ব্যবসার জন্যে গত মাস রেকর্ড ভালো সময় ছিল বলেই উল্লেখ করেন তিনি। গেল বছর ছিল বৈশ্বিক পোশাক শিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসহ সময়। সেসময় পূর্ববর্তী ২০১৯ সালের তুলনায় বিক্রিবাট্টা ১৭ শতাংশ কমে বলে জানা গেছে ইউরোমনিটর সূত্রে। সংস্থাটি আরও অনিশ্চয়তার শঙ্কাও করছে। ২০২১ সালে খুব খারাপ অবস্থা দেখা দিলে ১৫ শতাংশ বিক্রি কমার শঙ্কা করছে ম্যাককিন্সে। ইউরোমনিটর ১১ শতাংশের আভাস দেয়। সবমিলিয়ে কোনো আশার আলো কী আছে? অবশ্য, লকডাউনের ফলে একটি জিনিসের চাহিদা বেড়েছে, তা হলো; পায়জামা। মার্ক অ্যান্ড স্পেন্সারের মুখ্য নির্বাহী স্টিভ রোয়ি বলেন, ‘ব্রিটিশ নাগরিকেরা কী করছে জানতে চান-তারা এবার পায়জামা কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছেন।’ হিউগো বস’ও গ্রাহকদের একই প্রবণতার কথা জানায়। এই চাহিদা কিছু কারখানা মালিকদের কাছে সান্ত্বনার নামান্তর। ঢাকার ব্যবসায়ীদের সকলেই স্বীকার করেন, “লকডাউনে ঘরে থাকায় উন্নত বিশ্বে পায়জামার চাহিদা বাড়ছে। তবে পন্যটি উৎপাদনের সক্ষমতাও আমাদের সকলের নেই।” সূত্র: রয়টার্স।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here