Home বাংলা নিউজ নারীর হাতে ঘুরছে পোশাক কারখানার চাকা

নারীর হাতে ঘুরছে পোশাক কারখানার চাকা

বলা হয়ে থাকে, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকেরা বেশি নিষ্ঠাবান। আর সেই নিষ্ঠা ও দক্ষতা দিয়েই বাংলাদেশের নারীরা সচল রেখেছেন দেশের তৈরি পোশাক কারখানার চাকা। বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময়েও পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজ করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন কন্যা-বোন-মায়েরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নারী শ্রমিকের উপর ভিত্তি করেই এক সময়ে দেশে তৈরি পোশাক কারখানা যাত্রা শুরু করে। অল্প দামে শ্রম পাওয়ায় এক সময় দেশে বিস্তার লাভ করে তৈরি পোশাক শিল্প। এক সময় এই নারী শ্রমিকেরাই মজুরি বৈষম্যের শিকার হতেন। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতেন প্রতিনিয়ত। আর কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত না হওয়ায় যেকোনো দুর্ঘটনায় নারীদেরই জীবন দিতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তবে, এই অবস্থা এখন আগের চেয়ে কমেছে। নারীর কর্মপরিবেশও উন্নয়ত হয়েছে।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দেয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আয় হয় ১১ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই আয় ২৭.৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। তবে, ২০২০ সালজুড়ে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের কারণে এই আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে গেছে।
২০১৩ সালে বিবিএস এর এক জরিপে দেখা গেছে, পোশাকশিল্প খাতে পুরুষের অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। যেখানে নারীদের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তখন এই খাতে ২৯ লাখ ৯৭ হাজার লোক জড়িত ছিল। বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ লোক জড়িত রয়েছে। এর মাঝে নারী ও পুরষের অংশগ্রহণের হার প্রায় সমানে সমান। গত ৩৭ বছরে পোশাকশিল্পের এই অগ্রগতির জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান নারী শ্রমিকদের, এ কথা কমবেশি সবাই স্বীকার করেন। বিপুলসংখ্যক এই নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের কথা বলেন বিজিএমইএর নেতারা।
যদিও কারখানায় বিভিন্ন সময় নারীদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। এমনকি ঘটেছে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও। যার বড় উদাহরণ তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজা। তবে, এসব ঘটনার পর বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপে ঘুরে দাঁঁড়িয়েছে পোশাক শিল্প।
এছাড়া, বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডদের গঠিত দুই জোট- অ্যার্কড ও অ্যালায়েন্স কর্মপরিবেশ উন্নত করতে কারখানা পরিদর্শনের কাজ শুরু করেছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এ বিষয়ে কাজ করে চলেছে।
বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স ২,২০০ ফ্যাক্টরি নিয়ে কাজ করছে। এখন আমরা বলতে পারি, এই ২,২০০ ফ্যাক্টরিই এখন ‘কমপ্ল্যায়েন্স’৷তবে, বর্তমানে এ সংখ্যাটা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স এমপ্লয়িজ লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। বলতে গেলে অধিকাংশ পোশাক কারখানাই এখন কমপ্ল্যায়েন্স। অর্থাৎ কারখানার ভিতরে কাজের পরিবেশ ও অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়ে উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তবে, শ্রমিকদের জীবন-মানের উন্নয়ন হয়নি। কারণ, খরচ বাড়লেও তাদের বেতন সেভাবে বাড়েনি। তাই, নারীসহ অন্যান্য শ্রমিকদের ব্যক্তিগত জীবনের কোনো উন্নয়ন হয়নি।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মপরিবেশ নিয়ে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে কিংবা হচ্ছে। কিন্তু, নারীদের পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি উপেক্ষিতই থাকছে। একই সঙ্গে নিরাপদ চলাচল এবং কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারেও নেই কোনো উচ্চবাচ্য। তাদের স্বাস্থ্য সুবিধার বিষয়টিও দেখতে হবে।
এসআরএইচআর অ্যান্ড জেন্ডার নিয়ে কাজ করা মাশফিকা জামান সাতিয়ার বলেন, তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ প্রচেষ্টার ফলেই এ পরিবর্তন এসেছে। অনেক কারখানার কর্তৃপক্ষ নারীর স্বাস্থ্যের বিষয়টিও দেখছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন দিচ্ছে। কারখানাগুলো এটা বুঝেছে যে উৎপাদন বাড়াতে হলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যে নজর দিতে হবে।
দেশের বিভিন্ন কারখানায় নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক সংস্থা এসএনভি। করোনাকালেও শ্রমিকদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে এসএনভি বাংলাদেশের আরএমজি ইনক্লুসিভ বিজনেস প্রোগ্রামসের দলনেতা ফারথিবা রাহাত খান বলেন, করোনার শুরুতে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তখন স্বাস্থ্যসেবা পেতে শ্রমিকেরা সমস্যায় পড়েছিলেন। তবে, বড় ধরনের কোন সমস্যা হয়নি।
তবে, কারখানায় এখনও নারী শ্রমিকদের কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছেন। এর মধ্য অন্যতম হচ্ছে- বেতন বৈষম্য ও মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস না পাওয়া। সংশোধিত শ্রম আইনেও আগের মতোই মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি আরশাদ জামাল বলেন, ‘সব ক্রেতাই এখন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশেও নীতিমালা হয়েছে। নারীবান্ধব একটা শিল্প যেন হয় সে লক্ষ্যে বিজিএমইএ সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছে।’
নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উন্নতি হচ্ছে। যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তা ধীরে ধীরে সমাধান হবে। তবে, মজুরি বৈষম্যের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
সিপিডির গবেষণা বিভাগের কর্মকর্তা খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকেরা অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন-এই স্বীকৃতি বড় প্রাপ্তি। তবে, তার বিপরীতে নারীদের সামাজিক মূল্যায়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়নি। ন্যূনতম চাহিদার কিছু পূরণ হলেও গুণগত মানের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এক্ষেত্রে আরও কাজ করা প্রয়োজন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here