Home বাংলা নিউজ টি-শার্টে বিশ্বজয়

টি-শার্টে বিশ্বজয়

তৈরি পোশাকের বিভিন্ন ক্যাটাগরির মধ্যে টি-শার্ট অন্যতম। বাংলাদেশ এখন টি-শার্ট রপ্তানিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে প্রায় ধরে ফেলেছে। বিশ্বের অনেক দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের এই পণ্য। স্থানীয় বাজারেও এর চাহিদা বাড়ছে। টি-শার্টের উৎপাদন, রপ্তানি, চাহিদা, সরবরাহসহ নানা দিক তুলে ধরেছেন আবু হেনা মুহিব

হালকা, ছিমছাম ও আরাম- এই তিনে টি-শার্ট। আরামদায়ক পোশাক ছাড়াও প্রতিবাদের ভাষা কিংবা শুভ বার্তা প্রদর্শনে টি-শার্টের ব্যবহার একচ্ছত্র। সঙ্গে সাশ্রয়ী দাম। এই দুই সুবিধায় বাংলাদেশের টি-শার্টের কদর বিশ্বজোড়া। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। পোশাকের মধ্যে টি-শার্টেরই রপ্তানি বেশি। বাংলাদেশ তুলায় তৈরি পণ্য বেশি উৎপাদন করে। তবে সম্প্রতি কৃত্রিম তন্তু বা ম্যানমেইড ফাইবারে তৈরি টি-শার্ট উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ ধরনের টি-শার্টের দর অবশ্য কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। রপ্তানি বাজারের মতো অভ্যন্তরীণ বাজারেও টি-শার্টের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর দেশের বাজারে টি-শার্টের চাহিদা বাড়ছে ১৫ শতাংশের বেশি। এই চাহিদাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাজারে পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো টি-শার্ট তৈরি ও বিপণনে জোর দিচ্ছে। বছরে গড়ে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের টি-শার্ট রপ্তানি হয়। টাকায় এর পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানির ৭৩ শতাংশ আসে পাঁচটি পণ্য থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় টি-শার্ট। কভিডের আগে স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ৭১০ কোটি ডলারের টি-শার্ট রপ্তানি হয়েছে। কভিডে গেল অর্থবছরে বিশ্ব অর্থনীতি অস্থির ছিল। সব পণ্যের মতো টি-শার্টের বাজারেও পতন দেখা যায়। ফলে ওই অর্থবছরে টি-শার্টের রপ্তানি কমে আসে ৫৬১ কোটি ডলারে। তবে রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থান অক্ষুণ্ণ থাকে। ওই বছর দ্বিতীয় প্রধান পণ্য হিসেবে ট্রাউজারের রপ্তানি হয় ৫৪৫ কোটি ডলার। সোয়েটার ৩৬০ কোটি, জ্যাকেট ৩৫১ কোটি ও শার্ট রপ্তানি হয় ১৭৮ কোটি ডলারের।
ওয়ার্ল্ডস টপ এক্সপোর্টসের তথ্যানুযায়ী, টি-শার্ট রপ্তানিতেও বাংলাদেশ দ্বিতীয় রপ্তানিকারক। বরাবরের মতো চীন প্রধান রপ্তানি বাজার। বছরের চীনের রপ্তানি ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পোশাকের অন্যান্য পণ্যের মতো টি-শার্টে বাংলাদেশ-চীন তফাৎটা খুব বড় নয়। বিশ্ব পোশাক বাজারে চীনের অংশ এখন ৩৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ৭ শতাংশের কিছু কম। টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশের পরে যথাক্রমে আছে তুরস্ক, ভারত, জার্মানি, ভিয়েতনাম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও বেলজিয়াম। গন্তব্য হিসেবে ইউরোপই এখনও প্রধান বাজার। টি-শার্টের বিশ্ববাজার বছরে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। বাংলাদেশের টি-শার্টের মোট রপ্তানির প্রায় ৭৪ শতাংশই যায় ২৮ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) অন্যান্য মোট ৪২টি দেশে। তবে সবচেয়ে কম মাত্র শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ যায় আফ্রিকার দেশে। আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যায় ১৩ শতাংশ। নিজেদের মহাদেশ এশিয়ার টি-শার্টের বাজার ধরতে পারেনি বাংলাদেশ। এ অঞ্চলের ৪৭ দেশে রপ্তানি ১০ শতাংশেরও কম। তবে কম-বেশি পৃথিবীর সব দেশেই পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের টি-শার্ট। টি-শার্ট নিট ক্যাটাগরির পণ্য। নিট খাতের সংগঠন বাংলাদেশ নিট ম্যানুফ্যাচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশেনের (বিকেএমইএ) গবেষণায় চলতি অর্থবছরে টি-শার্টসহ বিভিন্ন ধরনের নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানির প্রাক্কলন করা হয়েছে ২১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০৪১ সালের জন্য প্রাক্কলিত পরিমাণ ৪১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। অন্তত ১০ ধরনের টি-শার্ট উৎপাদন ও রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাংটপ, প্ল্যাকার্ট, স্যান্ডো, সিংলেট ইত্যাদি। তবে টি-শার্টে এখন মূল্য সংযোজন করা হয়। রাজনৈতিক বক্তব্য, নির্বাচনী স্লোগান, প্রচারাভিযান এবং ক্রিকেট ও ফুটবলে বিভিন্ন দেশ এবং দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকরা বিভিন্ন লোগো ও ছবির শার্ট ব্যবহার করে থাকে। আইফেল টাওয়ারসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবিও থাকে টি-শার্টে। রং, প্রিন্ট, ওয়াশ এবং এক্সেসরিজের মান বিবেচনায় দামের পার্থক্য রয়েছে। এর দাম ১ থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত। দামে কম এবং বেশি ব্যবহারের কারণে জোড়া, তিনটির প্যাকেট, পাঁচটির প্যাকেট, দশটির প্যাকেট- এভাবে বেশি বিক্রি হয় টি-শার্ট। তবে বাংলাদেশের অন্যান্য পণ্যের মতো নিজেদের মধ্যে অবিবেচক প্রতিযোগিতার সুযোগ ক্রেতারা টি-শার্টের বেলায়ও নেয়। ভোক্তা পর্যায়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করতে কত কম দামে টি-শার্ট দেওয়া যায়, সে চেষ্টা থাকে তাদের।
৭০ শতাংশ তৈরি হয় নারায়ণগঞ্জে : হোসিয়ারি শিল্পের আঁতুড়ঘর হিসেবে খ্যাতি আছে নারায়ণগঞ্জের। সে সূত্রে টি-শার্টেরও। আশির দশকের শুরুতে প্রথমবারের মতো টি-শার্ট রপ্তানি হয় নারায়ণগঞ্জ থেকেই। এখন এ শহর থেকেই উৎপাদিত হয় রপ্তানির ৭০ শতাংশ টি-শার্ট। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত টানবাজার দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি সুতার বাজার। ব্রিটিশ শাসনের শেষার্ধে নারায়ণগঞ্জে উৎপাদিত সুতা ও কাপড়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। সে সময়ে নারায়ণগঞ্জকে বলা হতো ‘ম্যানচেস্টার অব এশিয়া’। বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯২৭ সালে শীতলক্ষ্যা তীরে বাবু সূর্য কুমার বোস গড়ে তোলেন ঢাকেশ্বরী কটন মিল। এর দুই বছর পর চিত্তরঞ্জন কটন মিল। পর্যায়ক্রমে আদমজী পাটকলের সঙ্গে হোসিয়ারি উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয় নারায়ণগঞ্জ। নিটওয়্যার শিল্পের উত্থানই নারায়ণগঞ্জ থেকে। এ কারণে নারায়ণগঞ্জকে নিটওয়্যার সিটিও বলা যায়। সারাবিশ্বেই নারায়ণগঞ্জের নিটওয়্যার বিশেষ করে টি-শার্ট রপ্তানি হয়। এখনও বাংলাদেশের সুতার বাজার মূলত নারায়ণগঞ্জকেন্দ্রিক। রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সুতাও টানবাজার থেকে যায়। নারায়ণগঞ্জের বিশেষ সুবিধা হচ্ছে, এখানকার পানি সাভার ও গাজীপুর অঞ্চল থেকে ভিন্ন। নারায়ণগঞ্জের পানি টি-শার্টের জন্য বিশেষ উপযোগী। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে দক্ষ শ্রমিকও পাওয়া যায়। সুতার সহজলভ্যতাও আছে। সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জকে বৈশ্বিক টি-শার্টের প্রধান জোগান কেন্দ্র বলা যায়। তবে নতুন শিল্পকারখানা নির্মাণে জমির সংকটে নারায়ণগঞ্জের বিকল্প হিসেবে সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়াসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে টি-শার্ট উৎপাদনযজ্ঞ।
কোথায় পিছিয়ে বাংলাদেশ :বিশ্বের খ্যাতনামা প্রায় সব ব্র্যান্ডই বাংলাদেশ থেকে টি-শার্ট সংগ্রহ করে থাকে। তবে কম দামের পণ্য হওয়ায় ওয়ালমার্ট, এইচঅ্যান্ডএম, প্রাইমার্কসহ ব্র্যান্ডগুলো বেশি সংগ্রহ করে থাকে। টি-শার্টের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে, কৃত্রিম তন্তুর পণ্য উৎপাদনে যেতে না পারা। ম্যানমেইড ফাইবারের টি-শার্ট উৎপাদনে যে ধরনের কাঁচামাল প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে বলতে গেলে হয় না। আবার এর জন্য প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কৃত্রিম তন্তুর বিশ্ববাজার এখন ১৫০ বিলিয়ন ডলারের। এতে বাংলাদেশের অংশ মাত্র তিন শতাংশ। উদ্যোক্তারা জানান, পলিয়েস্টার স্টেপল ও পেট্রোলিয়াম ফাইবার থেকে উৎপাদিত সুতা হচ্ছে পলিয়েস্টার স্টেপল। ক্রুড অয়েল ও পরিত্যক্ত প্লাস্টিক হচ্ছে এ জাতীয় সুতার প্রধান কাঁচামাল। শিপন, জর্জেট, পলিমার ইত্যাদি উৎপাদনে এ সুতা ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন পশুর পশম থেকেও ম্যানমেইড ফাইবার উৎপাদন করা হয়। স্থানীয় বাজার : দেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের টি-শার্ট পাওয়া যায়। স্থানীয় উৎপাদকরা নিজস্ব ডিজাইন ও কাপড়ে তৈরি করে বাজারজাত করছেন। পাইকারি বিক্রির জন্য ঢাকার মিরপুর ও কেরানীগঞ্জে টি-শার্ট তৈরির আলাদা উদ্যোক্তা রয়েছেন। স্থানীয় উৎপাদকদের মধ্যে ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ড দুটোই রয়েছে। নন-ব্র্যান্ডের টি-শার্টই বেশি। তবে ব্র্যান্ডগুলো উন্নত মানের কাপড় ও ডিজাইনের টি-শার্ট বাজারজাত করছে। সেগুলোর দামও বেশি। নন ব্র্যান্ডের টি-শার্ট ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর ব্র্যান্ডের টি-শার্ট গড়ে ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। সমসাময়িক বৈশ্বিক ডিজাইনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের বাজারের জন্য টি-শার্ট তৈরি করছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে রপ্তানির জন্য তৈরি করা টি-শার্ট কোনো কারণে রপ্তানি করতে না পারলে তার কিছু অংশ দেশে বিক্রি হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here