করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য ধসের পাশাপাশি বিনিয়োগে নাটকীয় পতন হয়েছে। এ ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। ২০২০ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ১০.৮ শতাংশ কমে হয়েছে ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গতকাল সোমবার জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকটাড প্রকাশিত ‘বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন ২০২১’-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এফডিআই কমলেও ২০২০ সালে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে এফডিআই অর্জনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম স্থানে কম্বোডিয়া। এ দেশটির এফডিআই মাত্র ১ শতাংশ কমে হয়েছে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইথিওপিয়া, চতুর্থ মোজাম্বিক এবং পঞ্চম স্থানে মিয়ানমার। বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারে এফডিআই প্রবাহ ৩৩.৭ শতাংশ কমে হয়েছে ১.৮ বিলিয়ন ডলার।
আংকটাডের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ ২০১৫ সালে ছিল ২২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ২০১৬ সালে ২৩৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে ২১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০১৮ সালে ৩৬১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ২০২০ সালে এসেছে ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে বলা হয়, বাংলাদেশের এফডিআই কমেছে ১০.৮ শতাংশ আর শ্রীলঙ্কার কমেছে ৪৩ শতাংশ। এর কারণ গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে পোশাকের বিপুল অর্ডার কমে যাওয়া। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার এফডিআই প্রবাহে পুনরুদ্ধার ঘটতে দীর্ঘমেয়াদে সময় লাগবে। কারণ এ দেশগুলোতে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি খুব একটা বেশি নয়। যেমন ২০২০ সালে ঘোষিত গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ প্রকল্প আগামী কয়েক বছরের এফডিআই প্রবাহ কেমন হবে তার একটি নির্দেশক। এতে দেখা যায়, গত বছর বাংলাদেশে ঘোষিত গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ প্রকল্প কমেছে ৮৭ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় কমেছে ৯৬ শতাংশ। এ সংকোচনের কারণ তৈরি পোশাক উৎপাদনে বিদেশিদের বিনিয়োগ আগ্রহ কমা। অথচ তৈরি পোশাক বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার রপ্তানির পাশাপাাশ এফডিআই আকর্ষণে অন্যতম শীর্ষ খাত। ২০২০ সালে বাংলাদেশের পোশাক খাত থেকে ৩০০ কোটি ডলার মূল্যের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। যার প্রায় সবটা বাতিল হয়েছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
আংকটাডের মতে, বিনিয়োগের খাতও বদলে যাচ্ছে। বড় আকারের অ-নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং ফিন্যান্স প্রকল্প থেকে বিনিয়োগ এখন ফিনটেক, ওষুধশিল্প, তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং কৃষি বাণিজ্যের দিকে যাচ্ছে। আর এ খাতগুলোতে বাংলাদেশ সরকারও সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিচ্ছে। তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বাণিজ্য সহজীকরণসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। বিনিয়োগে বাধা দূর করতে এরই মধ্যে পাঁচটি আইন সংস্কার করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে কমলেও ভারতের কল্যাণে দক্ষিণ এশিয়ায় সার্বিকভাবে এফডিআই ২০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭১ বিলিয়ন ডলার। শুধু ভারতে গত বছর এফডিআই ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬৪ বিলিয়ন ডলার। করোনা মহামারি নিয়ে ভারত সংকটে থাকলেও দেশটির আইসিটি ও নির্মাণ খাতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ এসেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগে ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ দ্বিতীয় দফা করোনা মহামারিতে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি সংকোচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি ঘোষিত গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগও কমেছে ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে এফডিআই ৬ শতাংশ কমে হয়েছে ২.১ বিলিয়ন ডলার। তবে এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি চীনে এফডিআই ৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪৯ বিলিয়ন ডলার।
আংকটাডের মতে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে এফডিআইর নাটকীয় পতন ঘটেছে। ২০২০ সালে বিশ্বে এফডিআই ৩৫ শতাংশ কমে হয়েছে এক ট্রিলিয়ন ডলার। যেখানে ২০১৯ সালে বিনিয়োগ ছিল ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এমনকি এ বিনিয়োগ ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ের চেয়েও ২০ শতাংশ কম। উন্নত দেশগুলোতে এফডিআই ৫৮ শতাংশ কমে হয়েছে ৩১২ বিলিয়ন ডলার।
এফডিআই আকর্ষণে শীর্ষ ১০টি দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো ও সুইডেন। অন্যদিকে বিনিয়োগকারী হিসেবে শীর্ষ ১০টি দেশ হচ্ছে চীন, লুক্সেমবার্গ, জাপান, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর।