চট্টগ্রামের ১৭টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে রপ্তানি পণ্যভর্তি কনটেইনার জটিলতা নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই স্বস্তিকর অবস্থায় চলে এসেছে। গেল এক সপ্তাহের হিসাবে দেখা যায়, প্রত্যেক ডিপোতে বর্তমানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার পণ্যসহ কনটেইনারের উপস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কনটেইনার সমস্যার সমাধান হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সাধুবাদ জানাই। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরাও আশাকরি এই বিষয়ে কিছুটা শঙ্কামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এই সুখকর অনুভুতির ধারাবাহিকতা দরকার। আবারও বলছি, টেকসই সমাধান দরকার। গেল মাসে কনটেইনার ডিপোতে জটিলতা সমাধানের জন্য সবার নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের পোশাক কারখানায় লকডাউন এবং ঈদকালীন ছুটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একথা অনস্বীকার্য। প্রায় ১০-১১ দিন পোশাক উৎপাদন বন্ধ থাকায় বন্দরে রপ্তানিতে বাড়তি কোনো চাপ পড়েনি, ফলে জমে থাকা কনটেইনার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাহাজে পৌঁছাতে পেরেছে। কিন্তু এরকম ঘটনাতো সব সময়ের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে না। আবারও বদলে যেতে পারে দৃশ্যপট। সুতরাং এখনই সময় কনটেইনার জটিলতার টেকসই সমাধান খোঁজার। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তৈরি পোশাকশিল্প এবং ফ্রেইট-ফরওয়ার্ডিং সেক্টরে জড়িত থাকার সুবাদে আমার ভাবনায় সমাধানের যে টেকসই একটা রূপরেখা তৈরি হয়েছে তা সবিনয়ে জানাতে চাই।
নিয়মিত মনিটরিং
পণ্য রপ্তানি সমস্যা নিরসনে জাহাজ ও কনটেইনার সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিজিএমইএর আন্তরিক উদ্যোগ সবার নজরে পড়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে এখন থেকেই টেকসই সমাধানের জন্য পথ সন্ধান করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর ও রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ যদি নিয়মিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করে তাহলে হয়তো অঙ্কুরেই সমাধানের পথ খোঁজা যাবে। মাদার ভেসেল বা মেইন লাইন অপারেটর, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বিজিএমইএ বা অন্যান্য আমদানি-রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধির মধ্যে ধারাবাহিক আর নিয়মিত আলোচনা টেকসই সমাধানের পথকে অনেক সহজ করবে। নিয়মিত যোগাযোগে সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত হবে এবং সমাধানের রূপরেখা পাবে।
ধারণক্ষমতা সম্প্রসারণ
নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। আশির দশকে মাত্র ১২ হাজার ডলার দিয়ে যে রপ্তানি শুরু হয়েছে আজ তা ৩৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত। আগামীতে এই রপ্তানি আরও অগ্রসর হবে। কিন্তু সেই তুলনায় বন্দরের কনটেইনার ধারণক্ষমতা এবং অন্যান্য সামর্থ্য কি বৃদ্ধি পেয়েছে? ক্রমবর্ধমান রপ্তানির সাথে কনটেইনার ধারণক্ষমতার একটা সামঞ্জস্য প্রয়োজন।
ফিডার জাহাজ বৃদ্ধি
অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, অধিকাংশ সময়ে দেখা যায় প্রয়োজনের তুলনায় ফিডার জাহাজ কম থাকায় পণ্যভর্তি কনটেইনার মাদার ভেসেলে পৌঁছতে বেগ পেতে হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতিটি ধাপে প্রতি দিন, প্রতি ঘন্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিলম্ব কখনো কখনো দীর্ঘায়িত হয়।
বর্তমান রপ্তানি পরিমাণের সাথে চলমান ফিডার জাহাজের আনুপাতিক সংখ্যা একেবারে অপ্রতুল। সুতরাং জাহাজীকরণে দ্রুততা আনতে ফিডার জাহাজের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
মাদার ভেসেলের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি
দ্বিতীয় বা তৃতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে শীর্ষস্থানীয় মেইন লাইন অপারেটর বা মাদার ভেসেল কোম্পানিগুলো এখনো উদারভাবে বিষয়টি ভাবতে পারেনি। সুদূর চীন, শ্রীলঙ্কা কিংবা মালয়েশিয়া থেকে আসা মাদার ভেসেলগুলো বাংলাদেশের রপ্তানি পরিমান বিবেচনা করে জায়গা বরাদ্দ করা উচিত। মাদার ভেসেলে বাংলাদেশের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দ না থাকলে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে না। পিক বা অপ পিক যেকোনো সময়ের জন্য মাদার ভেসেলে বাংলাদেশের জন্য চাহিদা অনুযায়ী পরিসর দরকার। চট্টগ্রাম বন্দর এবং রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উদ্যোগী হলে আমরা একটা কার্যকর সমাধানের রূপরেখা পাবো।
এক্ষেত্রে বলা দরকার যে, বায়ার যদি নির্দিষ্ট একটির বদলে একাধিক লাইন অপারেটর, ফ্রেইট ফরোয়ার্ড এজেন্সি নমিনেশন দেয় তাহলে পোশাক রপ্তানিকারকদের সুবিধা হবে।
অধিক কনটেইনার ডিপো ব্যবহার
রপ্তানি প্রক্রিয়ায় যেসব ফ্রেইট-ফরওয়ার্ড এজেন্সি কাজ করে তারাও সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এজেন্সিগুলো এক বা দুটি কনটেইনার ডিপো ব্যবহার না করে যদি চার-পাঁচটি ডিপো ব্যবহারের পরিকল্পনা করে তাহলে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো আটকে থাকবে না। একাধিক ডিপো ব্যবহার বিবেচনায় আনলে একটি বা দুটি ডিপোর ওপর নির্ভরশীলতা কমবে।
আবারও কোনো গভীর সঙ্কটে পড়ার আগে সম্মিলিতভাবে আমরা যদি কনটেইনার জটিলতার স্থায়ী সমাধান নিয়ে ভাবনা এবং বাস্তবায়নের পথ খুঁজি তাহলেই আমাদের স্বস্তিটিও হয়তো টেকসই হবে। সময়ের সাথে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু উৎপাদন নয়, রপ্তানি প্রক্রিয়াতেও আরও সময়োপযোগী এবং উন্নত হবে। এই প্রত্যাশাই এখন কাঙ্ক্ষিত।