বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি।’
মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হলো বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সুখবর দিয়ে।
গত অর্থবছরে ৩৫০ কোটি ১০ লাখ (৩.৫০ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বাংলাদেশে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি, ৩৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে ১৭৭ কোটি ১০ লাখ ডলার হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে। এ কারণেই করোনা মহামারির মধ্যেও এফডিআই খানিকটা বেড়েছে বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার বিদেশি বিনিয়োগের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৫০ কোটি ১০ লাখ ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পেয়েছিল ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ হিসাবেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
গত অর্থবছরে নিট এফডিআই এসেছে ১৭৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে এসেছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি ৩৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
তবে বছরের হিসাবে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেশ খানিকটা কমেছে। ২০২০ সালে ৩৩৭ কোটি ৮৫ লাখ (৩.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এই অঙ্ক ২০১৯ সালের চেয়ে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ কম। আর ২০১৮ সালের চেয়ে কম প্রায় ২৬ শতাংশ।
২০১৯ সালে ৩৯৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে এসেছিল ৪৫৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার; যা একক বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগ।
ওই বছরে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।
২০২০ সালে নিট এফডিআই কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। ২০২০ সালে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৫৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। ২০১৯ ও ২০১৮ সালে নিট এফডিআইয়ের অঙ্ক ছিল যথাক্রমে ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ও ৩৬১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়।
গত ২১ জুন জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড ‘বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন ২০২১’ প্রকাশ করেছে। তাতে বছরভিত্তিক এফডিআইয়ের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মোট ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ (২.৫৬ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে বাংলাদেশে। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কম। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশে যে নিট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এফডিআইয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে আঙ্কটাড।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। মূলধন হিসাবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসাবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে।
এ তিন পদ্ধতির যেকোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ আসলে তা এফডিআই হিসাবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, খাদ্যে ১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে।
এই এফডিআইয়ের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ মূল পুঁজি, ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ এবং ৬ শতাংশ এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ।
২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে দেশে মোট ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে মূল পুঁজি এসেছে ৯১২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মুনাফা থেকে ও ঋণ থেকে বিনিয়োগ হয়েছে বাকি ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।
এই সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, মিসরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশগুলোর ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।
করোনার মধ্যেও এফডিআই বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি।’
এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, ‘বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সরকার বাস্তবায়ন করছে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে। এসব প্রকল্প পিপিপির আওতায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমেও হতে পারত। সে ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত।’
এরশাদ আহমেদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশি বিনিয়োগও কম হচ্ছে। এ দিকটাতেও নজর দিতে হবে।
‘করোনার প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ। ফলে এ বছর বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ দ্রুত শেষ হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে,’ বলেন তিনি।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে না।
‘গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার কারণে তা আরও কমে গেছে। সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে।’
তিনি বলেন, ‘করোনায় বিশ্ব বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় পুঁজির চলাচল একেবারে স্থবির ছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে। এর মধ্যেও যে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে এফডিআইয়ে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এটাকে আমি ভালোই বলব।’